রিয়াজ ওসমানী
২৬ মে ২০২১
রোহিঙ্গাদের প্রসঙ্গে সেই কবে থেকেই বলে আসছি যে তারা মায়ানমারে আর ফেরত যাচ্ছে না। এর কারণ প্রথম থেকেই স্পষ্ট ছিল। সেই দেশের সেনা প্রধানরা এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধরা তাদের দেশে মুসলমান রোহিঙ্গাদের আর চায় না। ইতিহাসের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে তারা রোহিঙ্গাদেরকে বাংলাদেশি আখ্যা দিয়ে রাখাইন প্রদেশ খালি করার চেষ্টায় লিপ্ত হয়। সেটা সাধন করার জন্য সেনারা রোহিঙ্গাদের উপর ৭১ সালের কায়দায় গণহত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন ইত্যাদি চালিয়ে সেই জনগোষ্ঠীকে জান বাঁচানোর জন্য পর্যায়ক্রমে নাফ নদী পার হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে বাধ্য করে।
বাংলাদেশ সরকার এটা জেনেও দেশবাসীকে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে এসেছে যে রোহিঙ্গাদেরকে সাময়িকভাবে আশ্রয় দেয়া হয়েছে এবং মায়ানমার সরকারের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে উদ্বাস্তুদেরকে ধীরে ধীরে তাদের আগের জায়গায় ফেরত পাঠানো হবে। অথচ মায়ানমারের সেরকম কোনো আগ্রহ প্রথম থেকেই ছিল না। কারণ তাদের আসল উদ্দেশ্যই ছিল রোহিঙ্গাদেরকে মায়ানমার থেকে চিরকালের জন্য উচ্ছেদ করা বা নির্মূল করা। উল্লেখ করতে চাই যে নাফ নদীতে ডুবে মরতে যাওয়া রোহিঙ্গাদেরকে বাংলাদেশে ঢুকতে দেয়ার সিদ্ধান্তটি ছিল বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে একেবারেই সঠিক এবং মানবিক। এর চেয়ে ভিন্ন কিছু কল্পনাও করা যায় না।
চীন এবং রুশ দেশ দুটো মায়ানমারের ঘনিষ্ট হওয়ায় এবং দুইটা দেশই জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী এবং প্রতিষেধ করতে সক্ষম সদস্য হওয়াতে জাতিসংঘ মারফত মায়ানমারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কোনো আন্তর্জাতিক পথ খোলা নেই। বিদেশি ও দেশি গণমাধ্যম এই দিকটি ভালোভাবে তুলে ধরতে পারলেও বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ ব্যাপারটি সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারেনি বা করতে চায়নি। সরকারের ভুল ব্যাখ্যাও সবাই মিলে গিলেছে। এখন আসল চিত্রটাই বের হয়ে আসছে। আশা করি এবার দেশের মানুষ ব্যাপারটি সঠিকভাবে বুঝতে পারবে।
তো এখন প্রশ্ন আসবেই যে এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অবস্থান কী হওয়া উচিৎ। তাদেরকে ভাসানচরে নিরাপদে রাখাটা একটা ভালো কিন্তু সাময়িক উদ্যোগ। আবারও বলছি যে এরা কেউ কোথাও যাচ্ছে না কারণ যাওয়ার জায়গাটি আর নেই। তো এরা কি বংশের পর বংশ এই দ্বীপেই তাদের জীবন পার করে দেবে? সেটা কি কোনোদিন মানবতার মানদন্ডের কাছাকাছি পৌঁছতে পারবে?
কখনোই না। বাংলাদেশ সরকারের এক্ষুণি যুক্তরাষ্ট্র এবং ক্যানাডার সাথে কূটনৈতিক তৎপরতায় ব্যস্ত হয়ে পড়তে হবে রোহিঙ্গাদেরকে গ্রহণ করে নেয়ার জন্য তাদেরকে আহবান করার লক্ষ্য নিয়ে। সেই দেশ দুটি ঐতিহাসিকভাবেই পৃথিবীর সবখান থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ শরণার্থী গ্রহণ করে আসছে, তাদেরকে পুনর্বাসন করে আসছে এবং পর্যায়ক্রমে তাদেরকে নাগরিকত্ব দিয়ে তাদেরকে নতুন জীবন শুরু করার দিগন্ত উন্মোচন করে দিয়েছে।
সব রোহিঙ্গারা যে এই সুবিধার আওতায় আসতে পারবে সেই নিশ্চয়তা নেই। হয়তো কেউই সেটার আওতায় আসতে পারবে না। যারাই বাংলাদেশে থাকবে বা থেকে যাবে, তাদেরকে আমাদের মাঝেই পুনর্বাসন করে ফেলতে হবে। তাদেরকে আইনি প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দিয়ে দিয়ে তাদেরকে তাদের পূর্ণাঙ্গ জীবন ভোগ করার সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। বিনিময়ে তারাও পাবে তাদের নতুন দেশ বাংলাদেশকে অনেক কিছু দেয়ার রাস্তাটি।
এই উদ্যোগটি অবশ্যই সময় সাপেক্ষ এবং জটিল। সেটা নিতে গেলে দেশের অনেক সমস্যার সন্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। তবে এখন যেই বোমা টিক টিক করছে তার চেয়ে সেই সমস্যাগুলো অপেক্ষাকৃত কম ভয়নক। উন্নত দেশ হওয়ার স্বপ্ন দেখি, উন্নত দেশের আচার-ব্যবহার শিখতে ও মানসিকতা দেখাতে অনিহা প্রকাশ করলে কি চলবে?
*********************
সাম্প্রতিক হালনাগাদঃ
বহুদিন পর রোহিঙ্গারা একটা সুখবর পেল। মায়ানমারে সেনাদের নিপীড়ন ও গণতন্ত্র উচ্ছেদের প্রেক্ষাপটে সকল বিরোধী দলগুলো একত্রিত হয়ে একটি সমান্তরাল সরকার ঘঠনের প্রক্রিয়া হিসেবে আন্তর্জাতিক চাপে ও কিছুটা নিজস্ব অভিজ্ঞতার আলোকে রোহিঙ্গাদেরকে মায়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। রোহিঙ্গারা এই প্রতিশ্রুতিতে কতখানি আস্থা রাখতে পারবে সেই প্রশ্ন আমিও করছি। কিন্তু বিরোধী দলগুলোর উপর এটা নিয়ে এখন আন্তর্জাতিক চাপ দ্বিগুন করতে হবে। এই প্রতিশ্রতি পোক্ত না হলে তাদের এই সমান্তরাল সরকারকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কখনোই যেন স্বীকৃতি না দেয়।
LikeLike