
রিয়াজ ওসমানী
২১ এপ্রিল ২০২২
বাংলাদেশে সমকামীদের অধিকারের কথা উঠলে কতই না প্রসঙ্গের আবির্ভাব ঘটে। এর মধ্যে ধর্মীয় প্রসঙ্গ একটি এবং রাষ্ট্রীয় প্রসঙ্গ আরেকটি৷ অনেকবার বলেছি যে ধর্মীয় প্রসঙ্গটি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক যেহেতু দেশের দণ্ডবিধিটি শরীয়া আইন দ্বারা গঠন করা হয়নি (কোনো দিন সেটা করতেও দেয়া যাবে না)। কাজেই এই বিষয়ে রাষ্ট্রীয় ব্যাপারটাই মুখ্য।
কিন্তু সেই প্রসঙ্গেও শোনা যায় যত আজগুবি কথা। আমাদের সংবিধানে নাকি সমকামিতা নিষিদ্ধ। এটা ডাহা মিথ্যা। সংবিধানের কোথাও এই বিষয়ে কিছু উল্লেখ করা নেই। অন্য দিকে আলাদা আইন করে সমকামীদের স্বীকৃতি চাওয়াটাও অপ্রয়োজনীয়। বস্তুত সেটা কোনো দেশে করা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। যেটা করা হয়েছে সেটা হচ্ছে সমকামীদেরকে রাষ্ট্রের চোখে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে রাখা আইনগুলোর বিলুপ্তকরণ বা পরিবর্তন।
বাংলাদেশে সেই আইনটা হচ্ছে দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা। অনেক দেশের মতো আমরাও বিলেতিদের রেখে যাওয়া এই কালো আইনটি স্বাধীনতা লাভের পরও রেখে দিয়েছি। এখানে ধারাটির একটি অনানুষ্ঠানিক বাংলা অনুবাদ দিলামঃ “যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো পুরুষ, নারী বা পশুর সাথে প্রকৃতিবিরুদ্ধ যৌনাচারে লিপ্ত হবে, তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে, অথবা দশ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা সহ জরিমানা দিতে বাধ্য করা হবে। ব্যাখ্যাঃ এই ধারাতে উল্লেখ করা দণ্ডনীয় যৌনাচার বলতে অনুপ্রবেশই যথেষ্ট।”
এখানে যেটা লক্ষণীয় সেটা হচ্ছে যে কোন প্রকার অনুপ্রবেশকে প্রকৃতিবিরুদ্ধ হিসেবে বিবেচিত করা হবে, তা সঠিকভাবে এই ধারাটিতে উল্লেখ করা হয়নি। কিন্তু কালক্রমে সবাই এখানে পায়ুসঙ্গমকে বুঝে নিয়েছে এবং এর ফলে সমকামীদেরকে অপরাধী বানিয়ে ফেলেছে৷ এখানে একটা বড় রকমের অযৌক্তিকতা আছে এবং এই ধারার ফলে বাংলাদেশে নারী সমকামীরাই বা কীভাবে অপরাধী হয়ে গেল সেই প্রশ্নটাও থেকে যায়।
এই আলোচনা বহু পুরানো আর তাই সেটা নিয়ে আর কথা না বাড়িয়ে দণ্ডবিধির ধারাটি কীভাবে সংশোধন করা যায় সেটা তুলে ধরতে চাই। সংজ্ঞাটি থেকে “পুরুষ, নারী বা” শব্দগুলো বাদ দিলেই এখানে ধারাটির মানে সম্পূর্ণ বদলে যায়। ধারাটি পড়তে তখন এরকম হবেঃ “যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো পশুর সাথে প্রকৃতিবিরুদ্ধ যৌনাচারে লিপ্ত হবে, তাকে……….”। অর্থাৎ ৩৭৭ ধারা তখন আর সমকামিতার বিরুদ্ধে বিবেচিত হবে না, বরং শুধু পশুকামিতার বিরুদ্ধে বিবেচিত হবে।
এই পরিবর্তনটা ছোট মনে হলেও বাংলাদেশে সেটা অর্জন করা পাহাড় সরানোর চেয়েও কঠিন, যার কারণগুলো ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক। তাই সব কিছুর আগে সবাইকে বুঝতে হবে বাংলাদেশের ঠিক কোন আইনটার ফলে কীভাবে দেশের সমকামীরা অপরাধী হয়ে গেল। তারপর সবাইকে স্পষ্ট করে বুঝতে হবে আইনটার কোন বিশেষ সংস্কারটি করতে পারলে সমকামীরা আর অপরাধী থাকবে না। ভবিষ্যতে দেশের সর্বোচ্চ আদালত ব্যবহার করে এই সংস্কারটি আনার কল্পনা করার আগে সবাইকে পরিষ্কার হয়ে যেতে হবে সংস্কারটা কোথাকার এবং কোন প্রকারের।
৩৭৭ ধারা নিয়ে সকলের মাঝেই একটা ধোঁয়াশা ধারণা কাজ করে৷ অনেকেই বাংলা অনুবাদটাও ঠিক মতো পড়েনি। সকলের দায়িত্ব এই প্রসঙ্গটার সম্বন্ধে ভালো করে অবহিত হয়ে যাওয়া। তারপরেই ভবিষ্যতের পরিকল্পনা আরেকটু সহজ হয়ে আসতে পারে।
দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারার এই সংস্কারটির পাশাপাশি আরেকটা অর্জনও করতে হবে। সম্প্রতি বাংলাদেশের সংসদে একটি যুগান্তকারী বৈষম্যবিরোধী আইনের খসড়া উত্থাপন করা হয়েছে৷ কিন্তু এখানে কৌশলে যৌন প্রবৃত্তিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। অন্যান্য সংখ্যালঘুদের মতো সমকামীরাও যেন এই বৈষম্যবিরোধী আইনের আওতায় আসে, তার জন্য যেসকল জিনিষের ভিত্তিতে কারোর বিরুদ্ধে বৈষম্য করা যাবে না, সেসকল জিনিষের তালিকায় যৌন প্রবৃত্তিকেও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এই বিষয়ে আমাদেরকে এখনই সোচ্চার হয়ে যেতে হবে।
পাছে এখনও অনেকে একটা ব্যাপারে স্পষ্ট হতে পারেনি, এখানে আবারও উল্লেখ করে দিচ্ছি যে একটা মানুষের যৌন প্রবৃত্তি তার জন্ম কিংবা তার জন্মের ঠিক পর থেকেই নির্ধারিত, এবং সেই নির্ধারিত যৌন প্রবৃত্তি আর বদল হবার নয়। এই বাস্তবতাটি সমকামীদের বেলায়েও যা, বিষমকামীদের বেলায়েও তা।
******************************