
রিয়াজ ওসমানী
৫ মার্চ ২০২২
ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার নিন্দা করতে গেলে বা সেটা নিয়ে আলাপ করতে গেলে প্রথমেই যা লক্ষ্য করেছি, তা হচ্ছে গত একশত বছর ধরে ঘটে যাওয়া এক বা দুই পরাশক্তি দ্বারা ঘটানো বিভিন্ন যুদ্ধ বা অন্য ঘটনাগুলোর ফিরিস্তি অথবা কৈফিয়ত জিজ্ঞাসা। ভাবটা এমন যে কোনো একটা ঘটনাকে এককভাবে পর্যবেক্ষণ বা বিশ্লেষণ করার কোনো অবকাশ নেই। সবই কেমন যেন একটা পূর্ব পরিকল্পিত রূপরেখারই ধারাবাহিকতা।
মুমিনদের মনে এই রূপরেখাটি হচ্ছে মুসলমান দুনিয়াটিকে চিরকাল পিষ্ট করে রাখার ইহুদি ও খ্রিস্টদের ষড়যন্ত্র। আর বুমবামদের মনে রূপরেখাটি হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্ব (প্রাক্তন সোভিয়েট ইউনিয়ন, বর্তমান রাশিয়া এবং তাদের আদর্শগত কিছু অবশিষ্ট দেশ) এবং তৃতীয় বিশ্বের বহু দেশকে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামরিক এমন কি আদর্শের দিক থেকে পিষ্ট করে রাখার জন্য প্রথম বিশ্বের (পশ্চিমা দেশগুলোর, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের) পুঁজিবাদী আগ্রাসন।
এই দুই গোত্র এক হয়ে বহু দশক ধরে স্থাপন করেছে চক্রান্তবাদের এক কারখানা। এই কারখানা থেকে কল্পনা, ভীতি আর অজ্ঞতার মিলন হয়ে ছিটকে পড়েছে বহু তত্ত্ব, অভিযোগ, আফসোস এবং অন্ধবিশ্বাসের অজস্র বস্তু। এই প্রক্রিয়ার সহায়ক হিসেবে কাজ করেছে সাধারণ মানুষের নিরক্ষরতা, ধর্ম ব্যবসা ও বাম বনিকদের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা, সাথে বাংলা ভাষায় অবাধ বিশ্ব সংবাদের অলভ্যতা।
একই মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ হয়ে এই দুই গোত্র বংশের পর বংশ সকলের মগজ এমনভাবে ধোলাই করে রেখেছে যে কারো সাথে ইউক্রেন বা অন্য কোনো ঘটনা নিয়ে আলাপ করতে শুরু করলেই আমাকে হতে হয় বাকি অনেকগুলো সংঘাতের সম্মুখীন। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ১) ইসরায়েলি-ফিলিস্তিনি সংঘাত (সাথে সাবরা-শাতিলা, গাজা, আরো কত কী!); ২) ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের দুইবার হামলা; ৩) আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের হামলা; ৪) লিবিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলা; ৫) হিরোশিমায় যুক্তরাষ্ট্রের আনবিক আঘাত ইত্যাদি ইত্যাদি। কৌশলবসত কারণে অথবা জারি করা অজ্ঞতার ফলে যেই ঘটনাগুলো এড়িয়ে যাওয়া হয় সেগুলোর মধ্যে অন্যতম ১) ১৯৭৯ সাল থেকে শুরু করে প্রাক্তন সোভিয়েট ইউনিয়নের ১০ বছর আফগানিস্তান অবৈধভাবে দখল; ২) সম্প্রতি সিরিয়ায় রাশিয়ার বোমাবাজিতে অসংখ্য মুসলমানের প্রাণহাণি; ৩) চেচনিয়াতে রাশিয়া দ্বারা অসংখ্য মানুষ হত্যা; ৪) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে জাপানের বর্বর চেহারা ও কীর্তি; ৫) সাম্প্রতিক কালে মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামিক স্টেট (আইএস)-এর উত্থানের আসল কারণ ও কীর্তি ৬) সৌদি আরব দ্বারা ইয়েমেন ধ্বংস ও হাজার হাজার মুসলমান হত্যা; ৭) আল-কায়দা ও আইএস দ্বারা সারা দুনিয়াতে হাজার হাজার মুসলমান ও অমুসলমান হত্যা; ৮) শিয়া ইরান ও সুন্নি ইরাকের দীর্ঘ দিনের সংঘাত ইত্যাদি ইত্যাদি।
প্রথমে উল্লেখিত যেই ঘটনাগুলোর সন্মুখীন হই, অনেক নেটবৃন্দ সেগুলোর নাম মাত্রই উল্লেখ করে, অনেকটা গা ঝাঁকুনির মতো করে। কিন্তু একেকটি ঘটনার সামান্য বিস্তারিত জানতে চাওয়া হলে আমি আরও সন্মুখীন হই অজ্ঞতার, আংশিক সত্যের, ভুল তথ্যের বা ডাহা মিথ্যার। মুখস্ত করা তালিকার ঘটনাগুলোর প্রকৃত ইতিহাস জানার কোনো প্রয়াস দেখিনি। দেখিনি তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে তৈরি করা অভিমত। জল্পনা-কল্পনা, ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত, সবই পেয়েছি। শুধু পাইনি তথ্য উপাত্ত। এই অপসংষ্কৃতির মাঝে বস্তুনিষ্ঠতার কোনো গুরুত্ব দেখিনি। দেখেছি শুধু একপেশে চর্বিত চর্বণ। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেই পূর্ব নির্ধারিত পরিকল্পনা।
ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুস্থ মস্তিষ্কের জন্য আমাদেরকে এই অপসংষ্কৃতিকে রুখে দাঁড়াতে হবে। প্রত্যেকটি ঘটনার নির্দিষ্ট পটভূমি ও ইতিহাস রয়েছে। প্রত্যেকটি ঘটনা তার নিজস্ব আলোচনার দাবিদার। একটা প্রসঙ্গ আসলেই তোতাপাখির মতো আরো ৫-১০টা প্রসঙ্গ টেনে এনে নিজের অজ্ঞতা প্রকাশ করাকে নিরুৎসাহিত করতে হবে। একটা ঘটনার বিস্তারিত ইতিহাস জানা ১০টা ঘটনার মুখস্ত করা নাম উচ্চারণের চেয়ে অনেক শ্রেষ্ঠ। আমি আমার ব্লগে পালাক্রমে কিছু কিছু ঘটনার আসল ইতিহাস তুলে ধরার চেষ্টা করেছি উইকিপিডিয়ায় গবেষণা করে। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আল-কায়দা এবং ইসলামিক স্টেট (আইএস)-এর আবির্ভাবের আসল কারণ (না, মুসলমানদের সর্বনাশ করার জন্য আমেরিকা বা ইসরায়েল সেগুলো তৈরি করে দেয়নি)। আর ইসরায়েলি-ফিলিস্তিনি সংঘাতটাও বাংলাদেশের গণমাধ্যমের কৃপায় সকলের ধারণা অনুযায়ী এতটা একপেশে নয়।
নবপ্রজন্মকে উদবুদ্ধ করতে হবে আমাদের আগের প্রজন্ম (কিংবা তারও আগের প্রজন্ম) থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া বৈশ্বিক ইতিহাস, চক্রান্তবাদী চিন্তাভাবনা, ধ্যানধারণা ইত্যাদি পরিহার করে গত একশত বছরের উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলোর আসল এবং বিস্তারিত ব্যাখ্যা খুঁজে বের করতে। এর জন্য এখন আন্তর্জাল (সাথে ইংরেজি লেখার ভাঙ্গা বাংলা অনুবাদ) সহজেই লভ্য। আর চলমান বৈশ্বিক ঘটনাবলি অনুসরণ করার জন্য নির্ভরযোগ্য সংবাদ মাধ্যম ব্যবহার করার জন্যেও তাদেরকে উৎসাহিত করতে হবে। আমার মতে বাংলা ভাষায় বর্তমানে এই মাধ্যমগুলো হচ্ছে বিবিসি বাংলা আর ডয়েচে ভেলে বাংলা। গত এক সপ্তাহে ফেসবুকে বুমবাম আর মুমিনদের পক্ষ থেকে ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা সংক্রান্ত যেই সকল আবর্জনা প্রকাশিত হয়েছে এবং যেগুলো কিচির মিচির করা অজ্ঞ নবীনদের দ্বারা পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে তা সত্যিই পীড়াদায়ক। মুমিন আর বুমবামরা একটা ভুক্তভোগীর চেতনা বিক্রি করে এত দিন নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। এটাকে আর প্রশ্রয় দেয়া যাবে না।