
রিয়াজ ওসমানী
২৯ সেপ্টেম্বর ২০২১
ধীরে ধীরে বাংলাদেশ তার যৌন সংখ্যালঘুদের উন্নততর দিনগুলোর দিকে অগ্রসর হচ্ছে – তাদের মাঝে সমকামী নারী ও পুরুষদের জন্য নয়, তবে রূপান্তরকামী, অদ্বৈত এবং আন্তঃলিঙ্গ মানুষদের জন্য – অর্থাৎ তাদের জন্য, যাদের জীবনের কোন এক সময়ে তাদের “লিঙ্গ পরিচয়”টা মুখ্য হয়ে উঠে জন্মের সময়ে অর্পিত “শারীরিক লিঙ্গ”-এর সাথে সেটার অসামঞ্জস্যতার কারণে। ডাক্তারি ভাষায় এই অসামঞ্জস্যতাটিকে আখ্যায়িত করা হয় “জেন্ডার ডিসফোরিয়া” নামে।
বিগত সময়ে সরকার এই মানুষদেরকে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে (যদিও আমার মতে এটা একটি ভুল শ্রেণিবিন্যাস)। এখন থেকে সকল প্রাথমিক পর্যায়ের বিদ্যালয়ের কাগজপত্রে নিজের লিঙ্গ পরিচয় উল্লেখ করার সময়ে নারী, পুরুষ এবং তৃতীয় লিঙ্গ থেকে যে কোনো একটা বাছাই করার উপায় থাকবে। এটা অনুমেয় যে আগামী দিনগুলোতে সকল সরকারি কাগজপত্রেই এই ব্যবস্থাটি থাকবে (কিছু জায়গায় তা ইতিমধ্যে বিদ্যমান)। সরকার আরো সিদ্ধান্ত নিয়েছে তৃতীয় লীঙ্গের মানুষদের বিষয়টি পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে, যাতে করে অল্প বয়সীরা তাদের মাঝেকার সেই মানুষগুলোর উপস্থিতি এবং মূল্য সম্বন্ধে আরো দীক্ষিত হয়। জন্মের সময়ে অর্পিত শারীরিক লিঙ্গের তুলনায় পরে একটি নতুন লিঙ্গ পরিচয় জানানোর মুহূর্ত আসলে ভবিষ্যতে তা সকল সরকারি খাতায় পরিবর্তন করার সুযোগ থাকবে।
একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান দেশে এসব ব্যাপার একটু আশ্চর্য করে দিতে পারে। কিন্তু বংশ পরম্পরায় এটা অনেকেরই জানা যে এই মানুষগুলোর অস্তিত্ব চিরকালই ছিল। তা না হলে কীভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় হিজরা সম্প্রদায় নামের একটি কৃত্রিম সামাজিক গঠনের ব্যাখ্যা দেবেন, যেখানে অনাদিকাল থেকে অনেক যৌন সংখ্যালঘু মানুষরা পরিবার এবং মূলধারার সমাজ থেকে ত্যাজ্য হয়ে আশ্রয় নিয়ে এসেছে? ইসলাম ধর্মও – যাদেরকে (ভুলভাবে) তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে ধরা হয়েছে – তাদের প্রতি কম কঠোর, বিশেষ করে সমকামী নারী ও পুরুষদের প্রতি সেই ধর্মের অচরণের তুলনায়। এবং মুসলমানরা সাধারণত এটা মেনে নেয় যে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদেরকে আল্লাহ্ – ভালোর কারণেই হোক বা মন্দের কারণে হোক – সেইভাবেই বানিয়েছেন। এখানে বলে রাখতে হবে যে এই দয়াশীল ভাবনাটি সমকামী নারী ও পুরুষদের প্রতি একেবারেই প্রদর্শন করা হয় না।
অতএব ক্ষুদ্র বিজয়গুলোর গুণগ্রহণ করা দরকার। আমি জানতে পেরেছি যে আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী যৌন সংখ্যালঘু বান্ধব, এবং নিঃসন্দেহে উনার যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষিত বয়ঃপ্রাপ্ত ছেলেমেয়েরা বাংলাদেশের রূপান্তরকামী, অদ্বৈত এবং আন্তঃলিঙ্গ মানুষদের ক্ষেত্রে একটি বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য তাকে উৎসাহ দিয়েছেন। কৃতিত্ব সেই সকল স্থানীয় সংগঠনগুলোর, যেগুলো বছরের পর বছর উল্লেখিত মানুষদের নিয়ে কাজ করেছে এবং সেই মানুষগুলোর দুর্দশা সামনে এনে তুলেছে। বাংলাদেশের কিছু বিশিষ্ট রূপান্তরকামী মানুষ, যারা অন্যদের কাছে নিজেদেরকে একটি উজ্জ্বল উদাহরণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নিরলস চেষ্টা চালিয়ে গেছেন, তাদেরকে বিশেষভাবে কদর করা উচিৎ। এর পরবর্তী পদক্ষেপ হতে হবে প্রয়োজন ক্ষেত্রে লিঙ্গ পরিবর্তন করার জন্য সকল প্রকার সরকারি ও বেসরকারি সহায়তার লভ্যতা।
সংবাদ সূত্রঃ বিবিসি বাংলা
কিছু শব্দের ব্যাখ্যা
যৌন সংখ্যালঘুঃ ১) যৌন প্রবৃত্তি (সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন; sexual orientation), যার অর্থ দাঁড়ায় একটা মানুষ কোন লিঙ্গের মানুষদের প্রতি যৌন আকর্ষণ বোধ করে সেটার যেই বংশাণু ভিত্তিক (জেনেটিক) নির্ণয়কারী, তার কারণে; অথবা ২) জেন্ডার ডিসফোরিয়া বা অন্য কিছুর ভিত্তিতে শারীরিক লিঙ্গের সাথে অন্তর্নিহিত লিঙ্গ পরিচয়ের অসামঞ্জস্যতার কারণে; অথবা ৩) যৌনতা এবং লিঙ্গ পরিচয় ভিত্তিক আরো বহুবিধ কারণে মূলধারার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষদের তুলনায় যারা ভিন্ন এবং সংখ্যালঘু। ইংরেজিতে এদেরকে বিভিন্ন শব্দের সংক্ষিপ্তকরণে এলজিবিটি (LGBT) বলা হয়। এলজিবিটির বর্ধিত ইংরেজি সংক্ষিপ্তকরণগুলো হচ্ছে এলজিবিটিকিউ (LGBTQ), এলজিবিটিকিউআইএ (LGBTQIA) ইত্যাদি।
রূপান্তরকামীঃ বয়ঃসন্ধিকাল বা তার আগে থেকেই যারা পূর্ণাঙ্গভাবে অনুধাবন করে যে তাদের অন্তর্নিহিত লিঙ্গ পরিচয়টি জন্মের সময়ে পাওয়া তাদের শারীরিক লিঙ্গ থেকে সম্পুর্ণ উলটো। এর অর্থ দাঁড়ায় যে তাদের বাহ্যিক চেহারা ছেলেদের মতো কিন্তু ভেতরে তাদের সত্ত্বাটি ঠিক মেয়েদের, অথবা ঠিক এর উল্টাটা (মেয়েদের শরীর কিন্তু ছেলেদের সত্ত্বা)। একজন মানুষের শারীরিক (বাহ্যিক) লিঙ্গ এবং তার অন্তরঙ্গ চেতনায় প্রতিষ্ঠিত লিঙ্গ পরিচয়ের মাঝেকার অসামঞ্জস্যতাটিকে জেন্ডার ডিসফোরিয়া (Gender Dysphoria) নামে আখ্যায়িত করা হয়। এই অবস্থাটি কিছু ছেলেদের মেয়েলীপনা ভাব অথবা কিছু মেয়েদের পুরুষালী ভাবের চেয়ে যথেষ্ট ভিন্ন এবং আরো অনেক গভীর। এই পরিণতিটি মানুষের জন্য অসম্ভব বেদনাদায়ক এবং নিঃসঙ্গ। এটার বিরতিহীন যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার একটিই উপায়। আর তা হচ্ছে নানা চিকিৎসার মাধ্যমে শরীরটাকে বদলে ফেলা যাতে করে ভেতরের সত্ত্বা আর বাইরের রূপটির মিলন হয়। ইংরেজিতে রূপান্তরকামীদেরকে ট্রান্সজেন্ডার (transgender) বলা হয়।
অদ্বৈতঃ বিশেষ কোনো কারণে যারা নিজেদেরকে নারী বা পুরুষ, এই দুইটা লিঙ্গের আওতায় নিজেদেরকে মনে করতে পারে না। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষরা আদীকাল থেকেই নারী বা পুরুষ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে এসেছে এবং তাদের শারীরিক লিঙ্গ এবং লিঙ্গ পরিচয় সেইভাবেই ফুঁটে উঠেছে। লিঙ্গের ছকটা যেন নারী ও পুরুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু অদ্বৈতরা নিজেদেরকে এই ছকে ফেলতে পারে না। তারা নারীও নয়, পুরুষও নয়। তবে তারা তৃতীয় কোনো লিঙ্গ বলেও দাবী করে না কারণ তারা লিঙ্গ ব্যাপারটাই মানে না। তাদের প্রশ্ন হলো তাহলে প্রথম লিঙ্গ কারা আর দ্বিতীয় লিঙ্গ কারা? এই মানুষরা লিঙ্গের দ্বৈততা মানতে নারাজ। কাজেই তারা অদ্বৈত। ইংরেজিতে এদেরকে বলা হয় নন-বাইনারী (non-binary). বাহ্যিকভাবে এরা নারীর মতো দেখতে হতে পারে, পুরুষের মতো দেখতে হতে পারে বা মাঝামাঝি কিছু। এদের শারীরিক লিঙ্গ অনেকটা অপ্রাসঙ্গিক।
আন্তঃলিঙ্গঃ জন্ম থেকে যাদের যৌনাঙ্গ (এবং/অথবা প্রজনন অঙ্গ) পূর্ণাঙ্গ নারী বা পুরুষদের মতো নয়, অথবা নারী বা পুরুষ উভয়দেরই যৌনাঙ্গ (এবং/অথবা প্রজনন অঙ্গ) যাদের মধ্যে বিদ্যমান। এই অবস্থার ফলে এরা কীভাবে নিজেদের আত্মপরিচয় প্রকাশ করবে তা তারাই নির্ধারণ করে। তবে অনেকের জন্মের সময়েই ডাক্তাররা অস্ত্রপ্রচারের মাধ্যমে তাদেরকে নারী বা পুরুষের যৌনাঙ্গ বা প্রজনন অঙ্গ নির্ধারণ করে দেয়ার চেষ্টা করে। এই মানুষদের জীবন ও ভবিষ্যৎ নিয়ে এবং এখানে সংশ্লিষ্ট নৈতিকতা বিবেচনায় রেখে সমাজে আরো খোলামেলা আলোচনার অবকাশ আছে। ইংরেজিতে এদেরকে ইন্টারসেক্স (intersex) বলা হয়।
শারীরিক লিঙ্গঃ জন্মের সময়ে যৌনাঙ্গ (এবং/অথবা প্রজনন অঙ্গ) পর্যবেক্ষণ করে ডাক্তার বা পরিবারগন শিশুকে নারী/পুরুষ ছকের যেই ভাগে ফেলে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষিত করে, সেটাই শারীরিক লিঙ্গ। ইংরেজিতে এটাকে জেন্ডার (gender) বা বাইয়োলজিকাল সেক্স (Biological Sex) বা শুধু সেক্স (sex) বলে।
লিঙ্গ পরিচয়ঃ একটি মানুষ লিঙ্গ ভিত্তিক শ্রেণিবিন্যাসে মনের গভীরের স্তর থেকে কীভাবে নিজেকে অনুভব করে এবং সেটার আদলে কীভাবে নিজেকে বাইরের দুনিয়ার কাছে উপস্থাপন করে, সেটাই লিঙ্গ পরিচয়। অধিকাংশ মানুষের ক্ষেত্রে এই অনুভূতি ও উপস্থাপনা সেই মানুষটার জন্ম থেকে পাওয়া শারীরিক লিঙ্গের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কিন্তু অল্প কিছু মানুষের জন্য সেই দুটো বিষয় তাদের শারীরিক লিঙ্গ থেকে ভিন্ন তো বটেই, অনেক সময়ে সেটার ঠিক উলটো। ইংরেজিতে লিঙ্গ পরিচয়কে জেন্ডার আইডেনটিটি (Gender Identity) বলা হয়।
জেন্ডার ডিসফোরিয়াঃ একটি মানুষের শারীরিক লিঙ্গ এবং পরবর্তিতে অনুভূত এবং অনুধাবিত হওয়া লিঙ্গ পরিচয়ের অসামঞ্জস্যতার কারণে প্রতিটি মুহুর্তের চরম অস্বস্তি, উৎকন্ঠা, উত্তেজনা, বিষণ্ণতা ইত্যাদি। রূপান্তরকামীরা এই অনুভূতিগুলোর নির্মম শিকার। Gender Dysphoria-কে কোনো মানসিক রোগের আওতায় ফেলা হয়নি। তবে উপরে উল্লেখিত উপসর্গগুলোর কারণে ডাক্তারি জগত থেকে যত্ন ও সমর্থনের প্রয়োজন। অনেক সময়ে এই অবস্থা থেকে সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব নানা চিকিৎসার মাধ্যমে বাহ্যিক শরীর বদলে ফেলে।
**********************