রিয়াজ ওসমানী
২৪ আগষ্ট ২০২১
তালেবান এবং আল-কায়দা যুক্তরাষ্ট্রের সৃষ্টি, বা যুক্তরাষ্ট্র মুসলমান দুনিয়ায় চরমপন্থী মুসলমান গোষ্ঠীগুলোকে উস্কানি দিয়ে পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করেছে, এগুলো চিরচারিত অলস ব্যাখ্যা যা একই সঙ্গে সুবিধাবাদী। এই ব্যাখ্যাগুলোর মাধ্যমে মুমিনরা সহজেই নিজেদের দোষ বা কমতির দায় আমেরিকার উপর চাঁপিয়ে দিয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচে। আর বামরাও “পুঁজিবাদী” যুক্তরাষ্ট্রকে হেয় করার আরেকটা হাতিয়ার খুঁজে পায়। অথচ বাস্তবতা আরও অনেক জটিল যা অনুধাবন করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র এবং প্রাক্তন সোভিয়েট ইউনিয়নের মধ্যকার স্নায়ুযুদ্ধ সম্বন্ধে জানতে হবে এবং ১৯৭৯ সালে সেই সোভিয়েট ইউনিয়ন একটি আফগান সাম্যবাদী সরকারকে সহায়তা করার নামে যেভাবে আফগানিস্তানকে ১০ বছরের জন্য সামরিকভাবে দখল করে ফেললো সেটার সম্বন্ধে অবহিত হতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশ তখন পশ্চিম এশিয়ায় সাম্যবাদ ঠ্যাকাতে সাম্যবাদ বিরোধী ইসলামপন্থী আফগান মুজাহিদীনদেরকে সহায়তা করেছিল।
মুজাহিদীনদের অবির্ভাব হয়েছিল কয়েকটি গেরিলা গোত্রের সমন্বয় হিসেবে তাদের দেশে আগ্রাসনবাদী সোভিয়েটদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য এবং স্থানীয় সাম্যবাদী সরকারকে উৎখাত করার জন্য। কিন্তু তালেবানের জন্ম তার কিছু পর আফগানিস্তানের বিভিন্ন দেওবন্দী মাদ্রাসায়। ১০ বছর পর মুজাহিদীনদের হাতে হেরে যাওয়ার পর আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েট সেনা প্রত্যাহারের পর মুজাহিদীনদের মধ্যেই ক্ষমতার জন্য লড়াই শুরু হয়ে যায়। সেই সময়ে মুজাহিদীনদের বিপক্ষ শক্তি হিসেবে তালেবানদের প্রকৃত উত্থান হয়। তারা আফগানিস্তান দখল করতে সক্ষম হয় এবং তাতে তারা পাকিস্তানের গোয়েন্দা বিভাগ আইএসআই-এর সহায়তা পায়।
আল-কায়দা অন্য দিকে ছিল সোভিয়েটদের বিরুদ্ধে লড়াই করা মধ্যপ্রাচ্য ভিত্তিক একটি ইসলামী গোষ্ঠী যেটা আফগান মুজাহিদীনদেরকে সহায়তা করেছিল৷ মার্কিন গোয়েন্দা বিভাগ সিআইএর বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে যে আল-কায়দা যখন মুজাহিদীনদের সমর্থন করছিল তখন তারা সিআইএর সমর্থন পেয়েছিল। এই অভিযোগের সত্যতা যাচাই করা সম্ভব নয় যেহেতু গোয়েন্দাদের কার্যকলাপ প্রকাশ্যে হয় না। তবে পাকিস্তান যে তালেবানদের সহায়তা করেছিল সেটা হয়েছিল প্রকাশ্যে। সোভিয়েট সেনাদের বিদায়ের পর আফগানিস্তান প্রথমে মুজাহিদীন ও তারপর তালেবানদের অধীনে চলে আসার পর আরব নাগরিক ওসামা বিন লাদেনের নেতৃত্বে আল-কায়দা গোষ্ঠীটি আফগানিস্তানে ঘাটি খুলে বসে।
সাম্যবাদীদের বিরুদ্ধে এত দিন সংগ্রাম করে বিন লাদেন ১৯৯৬ সালে উলটা যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধেই চলে যায়। ১৯৯১ সালে আমেরিকা কুয়েতকে ইরাকের আগ্রাসন থেকে মুক্ত করার পর মক্কা-মদিনার দেশে মার্কিন সেনার উপস্থিতি বিন লাদেন সহ্য করতে পারেনি এবং ইহুদি-খ্রিস্ট সম্প্রদায়ের উপর লাদেন জিহাদ ঘোষণা করে। ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের উপর আল-কায়দার ভয়াবহ আত্মঘাতি বিমান হামলা সেই জিহাদ ডাকেরই পরবর্তি অধ্যায়। বাকিটা ইতিহাস।
সিআইএর বিরুদ্ধে উপরে উল্লেখিত অভিযোগটি সত্য হলেও এর অর্থ কি এই দাঁড়ায় যে আমেরিকাই তালেবান ও আল-কায়দা তৈরি করেছে? এরকম সস্তা ব্যাখ্যা বংশের পর বংশ সবাই গিলেছে যা উপমহাদেশীয় মুসলমানদের মধ্যে একটি “বলির পাঠা” মানসিকতার জন্ম দিয়েছে যা উলটো জঙ্গিবাদ ছড়িয়েছে। সকলের উচিৎ নিজ ক্ষমতা অনুযায়ী বিস্তারিত জানার চেষ্টা করা। অন্তত জানার ইচ্ছাটা থাকতে হবে। আমি উইকিপিডিয়া ঘেটে এই সারমর্মটা লিখলাম এবং এর মধ্যে ভুলভ্রান্তি থাকতে পারে যা আমি আমার পাঠকদেরকে তুলে ধরার জন্য আমন্ত্রন জানাচ্ছি। আমি তখন ব্যাপারটা আরো ঘেটে দেখবো। কিন্তু সবার প্রতি অনুরোধ উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ধ্যান-ধারনা, জল্পনা-কল্পনা, ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত ইত্যাদি থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করুন। এখন আর স্নায়ুযুদ্ধের মৌসুম নেই।
বিঃ দ্রঃ একটু হালনাগাদ, মার্চ ২০২২। ইউক্রেনকে ঘিরে পশ্চিমা বিশ্ব আর রাশিয়ার মধ্যে আবার নতুন করে স্নায়ু যুদ্ধ শুরু হয়েছে।
*********************
এবার আসছি ইসলামিক স্টেট (আইএস)-এর প্রসঙ্গে। ২০০৪ সালে ইরাকে আল-কায়দার অবশিষ্ট একটি দল “আবু মুসাব আল জারকাউই” নামের একজনের নেতৃত্বে ইসলামিক স্টেট, আইসিস, আইসিল, আইএস বা দায়েশ নামে উদিত হয়। ২০০৭ সালে ইরাকে মার্কিন সেনার উপস্থিতি বৃদ্ধি করার পর দলটি কয়েক বছরের জন্য লুকিয়ে যায়। তবে ২০১১ সালে গোষ্ঠিটি আবার নতুন করে তার রূপ প্রকাশ করে। তারা ইরাক এবং সিরিয়ায় তখনকার অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন আক্রমণাত্বক অভিযানের মাধ্যমে তাদের দল ভারি করতে শুরু করে। ইরাকে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির জন্য ২০০৩ সালে শুরু করা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হামলা ও দখল অনেকাংশে দায়ী। আর সিরিয়ার অস্থিতিশীল পরিবেশ ছিল মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে “আরব স্প্রিং” নামের গনজাগরণের ধারাবাহিকতা যেখানে সিরিয়ার বহু নাগরিক স্বৈরাচারী নেতা বাশার আল-আসাদের বিরুদ্ধে জেগে উঠেছিল। ২০১৪ সালে ইরাকের মসুল আর তিক্রিত অঞ্চল দখল করে নিয়ে ইসলামিক স্টেটের পরের নেতা “আবু বাকর আল বাগদাদি” সিরিয়ার আলেপো থেকে শুরু করে ইরাকের দীয়ালা পর্যন্ত একটি ইসলামী খেলাফত তৈরির ঘোষণা দেয়।
তারপরেই বিশ্ববাসী তাদের বিভৎস রূপ দেখতে পায়। তাদের দখল করে নেয়া স্থানগুলোতে কীভাবে অজস্র স্থানীয় পুরুষদেরকে গরুর মতো জবাই করা হয় এবং নারীদেরকে বন্দী এবং/অথবা ধর্ষণ করা হয়, তা ছিল অবিশ্বাস্য। তলোয়ার দিয়ে বিদেশি সাংবাদিকদের গলা কর্তনের ভিডিও আইএসের লোক আন্তর্জালে ছড়িয়ে দেয়। যারাই খেলাফতের নামে মাত্র বিরোধিতা করেছে, তাদেরই বরণ করে নিতে হয়েছে তলোয়ারের ধারে বা বন্দুকের গুলিতে মৃত্যু। সমকামীদেরকে উঁচু দালান বা পাহাড় থেকে নিক্ষেপ করার ভিডিও প্রকাশিত হয়েছে। এই খেলাফতের দানবরা আরও যেটা করেছে তা হলো অজস্র স্থানীয় ইয়াজিদি নারীদের দাসী হিসেবে আটক করে ফেলে তাদেরকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ধর্ষণ এবং/অথবা খুন।
দানবরা এতটাই নেট বিশেষজ্ঞ ছিল যে তারা সুকৌশলে প্রচারণা করে সারা বিশ্বের বহু তরুণ ও তরুণীদেরকে এই খেলাফত প্রতিষ্ঠার ডাকে সারা দিতে সফল হয়। তাদেরকে একটা রোমাঞ্চকর চিত্র তুলে দিয়ে মুসলমান হওয়ার দায়িত্ব পালনের ডাক দেয়া হয়। এর প্রত্যুত্তরে প্রাথমিকভাবে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা থেকে বাংলাদেশি ও পাকিস্তানি বংশদ্ভুত বিলেতি, মার্কিন ও ক্যানাডিয়ান তরুণ নাগরিকরা পরিবার, বন্ধুবান্ধব ও প্রশাসনের নাকের ডগায় তুরস্ক হয়ে দায়েশে গিয়ে হাজির হয়। পরে আরও অনেক জায়গা থেকে মানুষ এসে ইসলামিক স্টেটের জনসংখ্যা বাড়াতে থাকে। আর সেই সাথে চলতে থাকে অভিযান, খুন আর ধর্ষণের মাধ্যমে খেলাফতের আয়তন বাড়ানো। বাইরে থেকে সেখানে আগত তরুণীদেরকে আইএস তরুণদের সাথে বিয়ে দিয়ে দেয়া হয়। তবে পাশাপাশি ইয়াজিদি দাসীদের ধর্ষণ চলতে থাকে।
২০১৪ সালেই যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ইরাক ও সিরিয়ায় আইএসের বিরুদ্ধে বিশাল অভিযান শুরু করা হয়। এতে ইরাকের অঞ্চলে জঙ্গি সংঘটনটি ব্যাপক এলাকা হারিয়ে ফেলে। কিন্তু সিরিয়ার আলেপো এবং রাক্কায় তাদের ঘাটি আরও শক্ত হয়। ২০১৫ সালে তারা অন্ততপক্ষে আরও আটটি দেশে তাদের বিভিন্ন শাখা স্থাপন করতে সক্ষম হয়। সেগুলোর মাধ্যমে ইসলামিক স্টেট তার খেলাফতের সীমানার বাইরেও অনেক আক্রমণ শুরু করে। একই বছরের অক্টোবর মাসে মিশরের আইসিস শাখা রুশের একটি বিমানকে বোমা মেরে সকল ২২৪ জন যাত্রিকে নিহত করে। নম্ভেম্বর মাসে ফ্রান্সের আইসিস শাখা প্যারিসে সন্মিলিত হামলা করে ১৩০ জনকে হত্যা করে এবং ৩০০ জনকে আহত করে। ২০১৬ সালের জুন মাসে যুক্তরাষ্ট্রে আইসিসের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা এক ব্যক্তি ফ্লোরিডায় একটি সমকামীদের নাইটক্লাবে গুলি চালিয়ে অন্তত চার ডজন মানুষকে খুন করে।
তবে দায়েশের বিরুদ্ধে ইরাকের নেতৃত্বে আভিযান চলতে থাকে এবং ২০১৭ সালের ডিসেম্বর নাগাদ জঙ্গি সংঘটনটি ইরাক ও সিরিয়া মিলে তার ৯৫ শতাংশ এলাকা হারিয়ে ফেলে। ইরাকে আইএসের বিরুদ্ধে জয় ঘোষণা করা হলেও তারা সারা দুনিয়াতে কিছু মানুষদের অনুপ্রাণিত করে বিভিন্ন আক্রমণ চালিয়ে যেতে সক্ষম হতে থাকে, উদাহরণ স্বরূপ নিউইয়র্ক শহরে। আইসিসকে নির্মূল করে দেয়ার জন্য ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে “সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্সেস” নামের একটি সামরিক বাহিনী সিরিয়ায় আইএসের অবশিষ্ট ঘাটিগুলোতে অভিযান চালায়। হাজিন নামের একটি শহর জঙ্গিদের কাছ থেকে নিয়ে নেয়ার পর তাদের দখলে বাকি থাকে ইরাকের সীমান্তে ইউফ্রেটিস নদীর তীর ঘেঁষে কিছু গ্রাম।
২০১৮ সালের ১৯ ডিসেম্বর তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডনাল্ড ট্রাম্প আইসিসের বিরুদ্ধে জয় ঘোষণা করলেও পরের বছর সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্সেস সিরিয়ার বাঘুজ নামের একটি স্থানে আইএসের শেষ ঘাটিটিতে আক্রমণ চালায়। সেই বছরের ২৩ মার্চে সামরিক বাহিনীটি বাঘুজকে ফিরিয়ে নিতে সক্ষম হয় এবং তারপর খেলাফতের আর কোনো অবশিষ্ট স্থান বলে কিছু বাকি থাকেনি। সকল জঙ্গি ও তাদের পরিবারগুলো গণহারে আত্মসমর্পণ করে। ২০১৯ সালের ২৬ অক্টোবরে সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে একটি মার্কিন অভিযানে ইসলামিক স্টেটের নেতা আবু বাকর আল বাগদাদিকে হত্যা করে ইতিহাসের এই বিভৎস অধ্যায়ের আপাত ইতি টেনে আনা হয়।
তাহলে এবার আসি বাংলাদেশের প্রসঙ্গে। দেশটির অগারাম গণমাধ্যম মধ্যপ্রাচ্যে ঘটে যাওয়া এত বড় একটা ক্যান্সারের ফিরিস্তি জনগনের কাছে তুলে ধরতে প্রয়োজন বোধ করেনি। দেশের মানুষ এই বিষয়ে কিছুই জানতে পারেনি। ছিটেফোঁটা যা জেনেছে তা সম্ভব হয়েছে মুমিনদের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মিথ্যা প্রচারণার মাধ্যমে। প্রথমে কারো কারো মুখে শুনেছি আল-কায়দার মতো ইসলামিক স্টেটকেও আমেরিকা তৈরি করে দিয়েছে মুসলমানদের মানহানি করা জন্য। আমি আরও আশ্চর্য হয়েছি এটা দেখে যে আইএস মানে যে “ইসলামিক স্টেট” সেটাও মানুষের অগোচরে আসেনি। এই সুযোগে অনেকে বলতে শুরু করেছিল আইএস মানে “ইসরায়েলি স্টেট”। ইহুদিরাই এই জঙ্গি সংঘটন তৈরি করে দিয়েছে ইসলামের নামে সন্ত্রাসবাদ ছড়ানোর জন্য।
তার উপর মুসলমানরা কখনও এই ধরণের কাজ করতে পারে না – এই জাতীয় প্রলাপ বাংলাদেশের জনগনকে আইএসের ব্যাপারে পাত্তা না দিতে সহায়তা করেছে। ইসলাম সন্ত্রাসবাদ সমর্থন করে না ইত্যাদি বক্তৃতা বহু পুরানো। তবে কোরআন ও হাদিসেই যে খেলাফত সৃষ্টি ও তার (বর্বর) মাধ্যমের সকল উৎপত্তি খুঁজে পাওয়া যায়, বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ সেই বাস্তবতার সাথে এখনো পরিচিত হয়নি।
তথ্য সূত্রঃ উইকিপিডিয়া এবং Wilson Center.