রিয়াজ ওসমানী

৬ জুলাই ২০২১

বাংলাদেশের পুঁথিগত মুখস্ত বিদ্যা এবং বিভিন্ন পেশা দেশের মানুষদেরকে কোন ধরণের জ্ঞান দান করেছে তা আমার বোধগম্য নয়। কয়েক দিন পরপরই শুনতে পাই গৃহকর্মীকে নির্যাতন করার জন্য আইনজীবী বা ডাক্তার গ্রেফতার। অভিযুক্তদের পেশা অবশ্য এখানে মুখ্য বিষয় নয়। তবুও শিক্ষার আদলে প্রতিষ্ঠিত পেশাজীবীরাও যখন এই সব কাজে লিপ্ত হয়, তখন প্রশ্ন জাগতেই পারে যে এদের শিক্ষার আলো কতটুকু ছিল।

ঠিক এরকম আরো ঘটনার খবর সামাজিক মাধ্যমের যুগে বেড়িয়ে আসছে যার একই রকম পুরানো ঘটনাগুলো বিগত দশকের পর দশক ছিল ধামাচাপা দেয়া। নিজের চোখে দেখেননি এগুলো? নিজেও এতে কখনো অংশগ্রহণ করেননি? এই অবস্থাটি যে বাংলাদেশের সমাজের আরেকটি ক্যান্সার সেটা উপলব্ধি করার ক্ষমতা কি আপনাদের আছে? এগুলো চিরতরে বন্ধ করার দায়িত্ব যে আমাদের সবার সেই হুঁশ কি আপনাদের নেই? প্রতিবেশি হয়ে আমাদের সকলের দায়িত্ব কোথাও থেকে গৃহকর্মীদের আর্তনাদের আওয়াজ আসতে শুরু করলে ৯১১ নম্বরে যোগাযোগ করা, নিজের চোখে গৃহকর্মীদের গায়ে খতের দাগ দেখলে মোবাইলের মাধ্যমে তা কতৃপক্ষের নজরে আনা। এবং এগুলো করতে হবে অত্যাচারকারীরা আপনার আপন পরিবারের মানুষজন হলেও।

সেই ছোট বেলা থেকেই দেখে এসেছি আমার আগের প্রজন্ম এবং তারও আগের প্রজন্মের মানুষরা কীভাবে অসহায় অবস্থায় কৃতদাস হিসেবে কাজ নেয়া গৃহকর্মীদেরকে (শিশু মেয়ে ও ছেলে থেকে শুরু করে বয়স্ক মহিলা পর্যন্ত) পান থেকে চুন খসার মত সামান্য অপরাধেই নির্মমভাবে প্রহার করেছে। সবার মধ্যেই ছিল এদের অসহায়ত্বের সুযোগ নেয়ার প্রতিযোগিতা। এদেরকে মানুষ হিসেবে গণ্য করার ক্ষমতা পরিবারের কারোরই ছিল না। অভিভাবকদের উদাহরণ দেখে দেখে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত বাচ্চারা অনেকেই এই সব গৃহকর্মীদের সাথে ন্যূনতম শ্রদ্ধাবোধ রেখে কথা বলতে শিখতো না।

এই কাজের মানুষদের চরম দারিদ্রের কারণে এদেরকে বিনা বেতনেই রাখা যেত। মাথার উপর একটা ছাদ, থালায় একটু খাবার আর শোয়ার জন্য মেঝের উপর একটা মাদুর দিলেই এদেরকে ঝাঁকে ঝাঁকে পাওয়া যেত। এরাও তাদের নিয়তি মেনে নিয়ে ছাদ, থালা আর মাদুরের সাথে বিলি করে দেয়া সকল মানসিক ও শারীরিক অত্যাচার মেনে নিত।

আবার এটাও দেখতাম যে কোনো পরিবারে একটা কাজের মানুষ বেশি দিন থাকতে পারতো না। এই সব অত্যাচার সহ্য করার ক্ষমতা শেষ হয়ে যাওয়ার পর জান বাঁচানোর জন্যই তারা চলে যেত। ওমা! তখন দেখি সেই সব বাড়িতে খনিকের জন্য রান্নাঘরে ভাত বসতো না, বাড়িঘর পরিষ্কার হতো না, কাপড়-চোপড় ধোয়া হতো না ইত্যাদি। অর্থাৎ জালেমরা যাদের সাথে দিনরাত অবাঞ্ছিত কুকুরের মতো ব্যবহার করতো, সেই কুকুরদেরই উপর তারা আবার পরগাছা হয়ে বাস করতো। দাসদের সেবা ছাড়া এনারা যেন নিশ্বাসও নিতে পারতো না।

আমি মনে প্রাণে কামনা করছি যে আমাদের দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির সাথে সাথে এমন একটা সময় আসবে যখন গৃহকর্ম করতে ইচ্ছুক এরকম একটা মানুষও খুঁজে পাওয়া যাবে না। সবাই পোশাক শিল্প বা অন্য কোথাও আত্মমর্যাদা নিয়ে কাজ করে বেঁচে থাকতে পারবে। আমাদের মাঝে সকল পরগাছারাও দাসদের উপর নির্ভরশীল না হয়ে নিজের ঘর গোছানো ও পরিষ্কার করা, কাপড় ধোয়া, এমন কি নিজের রান্নার কাজটাও শিখে নেবে৷ এবং সেখানে নারী ও পুরুষ বলতে পৃথক কিছু থাকবে না। সবাই রোজকার করবে আবার সমান ভাগে সংসারের কাজও সেরে নেবে। এই সমাজ না আসা পর্যন্ত “উন্নত দেশ” কথাটা বাংলাদেশের বেলায় খাটানো যাচ্ছে না।

*********************

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s