
রিয়াজ ওসমানী
১৯ মার্চ ২০২১
আমার পূর্ব প্রজন্ম, বর্তমান প্রজন্ম এবং তরুণ প্রজন্মের মধ্যে অনেককেই বলতে শুনি যে বাংলাদেশে হিন্দুরা খুব ভালো আছে! তারা খুব সম্ভবত ভারত এবং অন্যান্য যে সকল দেশে মুসলমানরা সংখ্যালঘু হয়ে বাস করছে সেসব দেশের সাথে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের অবস্থানের তুলনা করছেন। এই তুলনাটা কেন প্রাসঙ্গিক হবে? অন্য দেশের সাথে বাংলাদেশের তুলনাটা কেন করতে হবে? এটা কি সহজে অনুধাবন করা সম্ভব নয় যে বাংলাদেশের ব্যাপার বাংলাদেশেরই? এই দেশে ধর্মীয় সম্প্রীতির মাপকাটিটা নির্ধারণ করবে এক মাত্র বাংলাদেশিরাই? পার্শ্ববর্তী দেশ বা দূর দূরান্তের দেশে কী হচ্ছে সেটার দায় আমাদের দেশের হিন্দু সম্প্রদায় কেন বহন করবে?
এর চেয়ে বড় করা কথা হচ্ছে যে বাংলাদেশে আমাদের হিন্দু ভাই-বোনরা ভালো আছে কি নেই এবং কতটুকু ভালো আছে বা কতটুকু খারাপ আছে তা উপস্থাপন করার এখতিয়ার এক মাত্র আমাদের হিন্দু ভাই-বোনদেরই। আর কারোর না। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান সম্প্রদায়ের বিন্দু মাত্র অধিকার নেই এখানে কোনো কথা বলার, হিন্দুদের কথা অগ্রাহ্য করার বা সেটার বিরূদ্ধ হওয়ার। কারণ সংখ্যালঘু হওয়ার ব্যক্তিগত, দৈনিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা কোনো দিনও সংখ্যাগরিষ্ঠদের হয় না। হাজার চেষ্টা করেও না। খাতা-কলমে কিছু কল্পনা করা যায়, ধারণা পোষণ করা যায় ইত্যাদি। কিন্তু যেই মানুষটা কোনো দিন বাচ্চা প্রসব করেনি, তার পক্ষে প্রসব দেয়ার অভিজ্ঞতা উপলব্ধি করা একেবারেই অসম্ভব।
আমাদের দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বা ধর্মীয় সম্প্রীতি নিয়ে আলোচনা শুরু করতে হলে এটাই হওয়া উচিৎ সকলের আদ্যস্থল। একজন হিন্দু মানুষ না হয়ে কখনোই কোথাও বক্তব্য রাখতে যাবেন না যে হিন্দুরা আমাদের দেশে খুব ভালো আছে বা ভালোই আছে। তারা সেটা আছে কি নেই, সেটা তাদের কাছ থেকেই মনোযোগ দিয়ে শুনবেন, বোঝার চেষ্টা করবেন, তাদের সাথে একাত্বতা প্রকাশ করবেন এবং তারা ভালো না থাকলে, আপনি কী কী কাজ করলে তারা ভালো থাকতে পারবে তা তাদের সাথে আলাপচারিতার মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠা করুন বাংলাদেশের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে।
একজন হিন্দু ফেসবুক ব্যবহারকারী হেফাজতের নেতা মামুনুল হককে সমালোচনা করলো দেখে সুনামগঞ্জের একটি গ্রামে অজস্র হিন্দু বাড়িঘর ও মন্দির লন্ডভন্ড করে দেয়া হলো। এরপরেও কি আপনারা বলবেন যে বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়টি মুসলমান সম্প্রদায়ের সাথে একই দুনিয়ায় বাস করছে? হেফাজতিরাই তো প্রকাশ্যে ভিন্ন ধর্মালম্বীদের নিয়ে যা তা খুশি বলে আসছে। কই? হিন্দুদেরকে তো মুসলমানদের বাড়িঘর, মসজিদ ইত্যাদি ভাঙচুর করতে দেখিনি? আপনাদের কি লজ্জা করেন না হিন্দুদের অবস্থান সম্বন্ধে নিজেদের অভিমত বা মূল্যায়নকে অধিকতর গুরুত্ব দিতে?
স্বাধীনতার পূর্ব এবং তার পর থেকে আজও রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাবানরা (তারা যেই দলেরই হোক না কেন) ধারাবাহিকভাবে হিন্দুদের জমি দখল করে আসছে। আজানের সময়ে উলু ধ্বনি চলবে না, অথচ উলু ধ্বনির সময়ে আজানের উপর নিষেধাজ্ঞা নেই, এগুলো কি হিন্দু ও মুসলমানদের সমান অবস্থানের পরিচয়? কবে বুঝতে পারবেন যে বাংলাদেশে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে এই অসমান পরিস্থিতির একটা সাংবিধানিক ভিত্তি জেনারেল এরশাদ তৈরি করে দিয়ে গেছেন যেটা অতীত প্রতিশ্রুতি সত্যেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপড়ে ফেলেননি। যত দিন বাংলাদেশের সংবিধানে একটা রাষ্ট্রধর্ম উল্লেখ করা আছে, তত দিন সেই রাষ্ট্রের চোখে সেই ধর্মের বাইরের সকল মানুষ দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। আর জেনারেল জিয়ার কেরামতিতে সংবিধানে যদি বিসমিল্লাহ থাকে তো সেই সংবিধান ভিন্ন ধর্মালম্বী বা নাস্তিকদের কাছে সমানভাবে প্রিয় হতে পারে না।
তাই ধর্মীয় সম্প্রীতির সবচেয়ে প্রথম শর্ত রাষ্ট্রীয়ভাবে নিরঙ্কুশ ধর্মনিরপেক্ষতা। এখানে ধর্মীয় সব ব্যাপারেই রাষ্ট্র থাকবে অন্ধ। আসুন এটা প্রতিষ্ঠা করার জন্য মরিয়া হয়ে পড়ি। এতে হিন্দুদের বাড়িঘর ও মন্দিরের উপর আক্রমণ কিছুটা হলেও কমবে কারণ সেগুলোকে রাজনৈতিকভাবে উস্কানি দেয়ার মতো মানুষ তখন কমে যাবে। রাজনৈতিক স্বার্থে রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্ম গোষ্ঠীগুলোকে দুধ-কলা খাওয়ানোর পথটাও সংকুচিত হবে।
অনেক আবাল মুমিনরা বলে থাকে যে বাংলাদেশে গণতন্ত্র মানে ৯০% মানুষ অর্থাৎ মুসলমানরা যা বলবে তাই। হ্যাঁ! সেটা ভোটের বাক্সে। কিন্তু একটি দেশে প্রকৃত গণতন্ত্রের চর্চা মানে সংখ্যাগরিষ্ঠদের ইচ্ছা কায়েম করার সময়ে সংখ্যালঘুদের স্বার্থ যেন কখনোই ক্ষুন্ন না হয় সেই পরষ্পর বিরোধী সংগ্রামটির সুষ্ঠ পরিচালনা। অতএব গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। বাংলাদেশে বর্তমানে এই দুটোর একটারো বাস্তবায়ন নেই বললেই চলে।
আবালদেরকে এটাও বলতে শুনেছি যে বাংলাদেশে রাষ্ট্রভাষা থাকলে রাষ্ট্রধর্মও থাকতে হবে। তাদেরকে দুটোর মধ্যে পার্থক্যটা সহজ ভাষায় বুঝিয়ে দিতে হয় বলে পরিতাপ হচ্ছে। একজন মানুষ একটু চেষ্টাতেই একটার বেশি ভাষা রপ্ত করতে পারে। কিন্তু সেই মানুষটা দেশের সমান নাগরিক হওয়ার উদ্দেশ্যে অত সহজে একই সাথে বিভিন্ন ধর্মে বিশ্বাসী এবং সেগুলোর অবলম্বনকারী হতে পারে না। দেশের প্রচলিত ধর্মগুলো কখনোই সেটার অনুমতি দেয়নি। আর একই উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে ধর্ম পরিবর্তন করাটা একজন মানুষের জন্য ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক আঙ্গিকে কঠিন এক পদক্ষেপ। কাজেই বাংলাদেশে রাষ্ট্রভাষার মাধ্যমে আমরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক তৈরি করিনি কিন্তু রাষ্ট্রধর্মের মাধ্যমে তা করেছি।
*********************