
রিয়াজ ওসমানী
০১ মার্চ ২০২১
আমার সম্প্রতি লেখা “বাংলা ভাষার প্যাঁচাল” নামের প্রচ্ছদটির পর এই লেখাটির একটি বিশেষ অনুরোধ আসাতে এই লেখাটিতে আমাকে একটি ভিন্ন অঙ্গনের দিকে মনোযোগ দিতে হয়েছে। “চেয়ার” ও “টেবিল” নামের বস্তুগুলো ছিল ইংরেজদের মাধ্যমে আমাদের মাঝে প্রচলিত করে দেয়া কিছু আসবাবপত্র, যেগুলোর বাংলা প্রতিশব্দ (কেদারা, কুর্সি ইত্যাদি) তেমন প্রচলিত হতে পারেনি। যুক্তি উপস্থাপন করা যায় যে যেহেতু এই বস্তুগুলোই ছিল বিদেশি এবং যেই সংষ্কৃতি থেকে সেগুলো আমাদের কাছে এসেছিল, সেখানে “চেয়ার” বা “টেবিল” শব্দগুলো ছিল সর্বব্যাপী, সেহেতু সেগুলোর বাংলা প্রতিশব্দ প্রতিষ্ঠিত করতে কেউ তেমন মাথা ঘামায়নি। চেয়ার এবং টেবিল আমাদের ভাষাতে সেই নামেই পরিচিত হয়ে গিয়েছে।
পর্তুগীজরা ইংরেজদেরও অনেক আগে আমাদের মাঝে “সাবোন” নামে গোসল করার একটা উপাদান নিয়ে এসেছিল। আমাদের মুখ সেই শব্দটিকে সময়ের সাথে সাথে একটু পালটে দিয়ে সাবান বানিয়ে ফেলেছে। ফরাসীদের কাছ থেকে আমরা পেয়েছি “রেস্তোরাঁ”। বাংলা ভাষায় এরকম আরো অনেক বস্তু বিষয়ক শব্দের উৎপত্তি হচ্ছে ভিন্ন সংষ্কৃতি ও ভাষা। প্রাচীন বাংলায় বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে বণিকরা এসেছিলেন – কেউ কেউ বাংলাকেই তাদের ভূমি হিসেবে বেঁছে নিয়েছিলেন। এই প্রক্রিয়ার ফলে তাদের আনা অনেক জিনিষগুলোর নাম আমাদের ভাষায় ঢুকে গিয়ে বাংলা ভাষাকে করেছে সমৃদ্ধ। এর আগে বাংলা ভাষায় এগুলোর নামই ছিল না কারণ আমাদের এই অঞ্চলে হয়তো সেই বস্তুগুলোরই কোনো হদিস ছিল না।
বর্তমান যুগে প্রযুক্তি আমাদের কাছে নিয়ে এসেছে কম্পিউটার, ল্যাপটপ, সিমকার্ড আরো কত কী! তার আগে এসেছে ক্যালকুলেটর, ফোন ও টেলিভিশন। এগুলোর প্রতিশব্দ বাংলা একাডেমি স্থাপন করার চেষ্টা করেনি এবং সেটা নিয়ে কারো মাথা ব্যথাও নেই। আমি বলবো যে এটা মেনে নেয়ার জন্য কিছু যুক্তি আছে এবং সেটা কী তা উপরে উল্লেখ করেছি। কিন্তু সবার কাছে আমার প্রশ্ন হচ্ছে যে এটার সাথে বর্তমান যুগে সকলের “বাংলিশ” বলার সম্পর্কটা কোথায়? বাংলিশ শব্দটির একটি মানে হচ্ছে বাংলা কথার মাঝে অর্ধেক বা অনেক শব্দেরই ইংরেজিটা বলা বা লেখা। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করতে পারিঃ “বাংলা একটা রিচ ল্যাঙ্গুয়েজ, আমি এই ভাষা ইউজ করতে ভালোবাসি”। আরো শুনতে পাওয়া যায়ঃ “আমি তোমাকে লাভ করি”। আমার এটাও শোনার দূর্ভাগ্য হয়েছেঃ “একটা কান্ট্রির এডমিনিস্ট্রেশন মাদার টাঙে হওয়া উচিৎ”।
ব্যঙ্গ করে আমি ফেসবুকে বেশ আগে এরকম একটা স্থিতি দিয়েছিলামঃ “একুশের মান্থ আসলে ল্যাংগুয়েজ মুভমেন্টের স্টোরিটা আমাকে অনেক ইন্সপায়ার করে”। এই ধরণের কথাবার্তার অবির্ভাব কীভাবে হলো, কারা মূলত এই সব শব্দদূষণের জন্য দায়ী, সেটা নিয়ে আমার “বাংলা ভাষার প্যাঁচাল” নামের প্রচ্ছদে বিশদ বিশ্লেষণ করেছি। এই লেখায় শুধু প্রশ্ন করবো যে বাংলা ভাষায় সাবান আর কম্পিউটারের আগমন কি নিজের জাত বাড়িয়ে, ঢং করে উপস্থিত বাংলা শব্দকে দুমড়ে মুচড়ে প্রতিস্থাপন করে ইংরেজি শব্দটা ঢোকানোর মতোই একটা বিষয়? পরের বিষয়টিকেও কি ভাষার চলমান প্রক্রিয়া ও বিবর্তন হিসেবে ধরে নেয়া যায়? যেই কারণে বাংলা ভাষার শব্দ গণনা সময়ের সাথে সাথে বৃদ্ধি পেয়েছে, সেই কারণেই কী “ভাই” হয়ে গিয়েছে “ব্রো”? বাজারে পণ্যের “দাম” হয়ে গিয়েছে “প্রাইস”? কাপড়ের রং হয়ে গিয়েছে “কালার”?
নগ্নভাবে বুঝিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছি যে পরের বিষয়টা বাংলা ভাষাটাকে সমৃদ্ধ করছে না। বরং একটি ক্ষতিকর (কেন সেটা আগের লেখায় বর্ণনা করেছি) প্রবণতার আদলে সুন্দর এবং যথাযথ কিছু বাংলা শব্দ প্রতিস্থাপন করে ইংরেজি শব্দের আগমন ঘটিয়ে কালের গর্ভে সেই বাংলা শব্দগুলো হারিয়ে ফেলার পথ সুগম করে দেয়া হচ্ছে। এই পার্থক্যটা সূক্ষ্ম হলেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হাওয়ায় গা ভাসানোর আগে সবাইকে একটা ব্যাপার অনুধাবন করতে অনুরোধ করছি। দিন শেষে যারা অনবরত বাংলিশ বলেন ও লিখেন, তারা বাংলা বা ইংরেজি, কোনোটারই পারদর্শিতা দাবী করতে পারেন না। মজার ব্যাপার হচ্ছে যে এই মানুষগুলো বাংলিশ বলে তারা যে ইংরেজি জানেন সেটাই সবাইকে বোঝাতে চেষ্টা করছেন। তবে আরো মজার ব্যাপার হচ্ছে যে তারা প্রকৃতপক্ষে তেমন ইংরেজিই জানেন না। যারা বাংলার সময়ে বাংলা, ইংরেজির সময়ে ইংরেজি – এই মনোভাব পোষণ করেন, তারাই প্রকৃতপক্ষে ইংরেজি জানেন, সাথে বাংলা তো বটেই।
সম্প্রতি ঘটে যাওয়া একটা ব্যাপার উল্লেখ না করলেই নয়। ঢাকার এক উদীয়মান আবাসিক এলাকায় সেটার চেয়েও উদীয়মান এক ভদ্র মহিলা অদূরে একটা গরু হেঁটে যাচ্ছে দেখে তার বাচ্চা মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বললেনঃ “বেবি! দেখো, কাও যাচ্ছে”। আমি যদি বাংলাদেশের আইনমন্ত্রী হতাম, তাহলে এই প্রকার ঢঙের প্রতিদান হিসেবে এই সকল ভদ্র মহিলা (সাথে ভদ্র লোক, তরুণ, তরুণী, যুবক, যুবতি)দেরকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় গ্রেফতার করে বিনা জামিনে দশ বছর হাজতে আটকে রাখার বিধানের সুপারিশ করতাম। এই মনোভাব পোষণ করার জন্য আমাকে যদি “ভাষা মৌলবাদী” বলা হয়, তো সেই সুনাম আমি আনন্দের সাথে মাথা পেতে নেব। জীবনটাকে স্বার্থক মনে করবো।
*********************