
বাংলাদেশি ও সকল বাংলাভাষী যৌন সংখ্যালঘু ও তাদের শুভানুধ্যায়ীদের উদ্দেশ্যে নিবেদিত আমার জীবনীটা ২০১৮ সালের জুলাই মাসে প্রকাশ করা হয়েছিল সদ্য বন্ধ করে দেয়া বৈচিত্র্য জালপাতায়। সেটাকে এখানে পুনরায় প্রকাশ করা হলো। কেউ এই লেখা পড়ে উপকৃত হলে আমার এই লেখা স্বার্থক হবে।
রিয়াজ ওসমানী
২০ ফেব্রুয়ারী ২০২১
আমি যৌবনে পা দেবার পর আমার আশেপাশে, বর্ধিত পরিবারে, সমাজে, টিভিতে ও চলচিত্রে আমার মনের মতো করে কীভাবে ভালোবাসতে হয়, কীভাবে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলতে হয়, কীভাবে যৌন সম্পর্ক করতে হয় তার কোনোটারই কোনো দৃষ্টান্ত বা উদাহরণ ছিল না। ছিল না কোনো দেখিয়ে দেয়া অনুমোদিত বিধি। আর তাই বোধহয় ২১ বছরে পা দেয়ার আগ পর্যন্ত আমি ছিলাম নিষ্কাম। এই নিষ্কামিতাকে আমি খুব একটা আশ্চর্যবোধক মনে করিনি কারণ আমি বড় হয়েছি একজন বাংলাদেশি মুসলমান পরিবারে। এবং আমাদের সমাজে এটাই সকলের বিশ্বাস এবং প্রত্যাশা ছিল যে একটা মেয়েকে বিয়ে করার আগ পর্যন্ত একটা ছেলের যৌন অভিজ্ঞতা বলতে কিছুই থাকবে না। সব হবে বিয়ের পর। তখন আমার বিয়ের বয়সও হয়নি, তাই কারো সাথে কোনো যৌন সম্পর্কও হয় নি। এই বলে নিজেকে বেশ মানিয়ে নিতাম একটা পরিবেশে যেখানে আমার সমবয়সী প্রায় সব ছেলেরাই ইতিমধ্যে কোনো না কোনো বান্ধবির সাথে প্রেমের এবং যৌন সম্পর্ক করে ফেলেছে। সেই পরিবেশটা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের একটা বিশ্ববিদ্যালয় ভিত্তিক শহরে, যেখানে ১৮ বছর বয়স থেকে আমি একটা নতুন জীবন শুরু করি।
তার আগে দেশ ছেড়েছি ১৩ বছর বয়সে। বাবা-মা ও বোনদের সাথে স্ক্যান্ডিনেভিয়ার ফিনল্যান্ড দেশটিতে পাড়ি জমাই বাবার চাকরির কারণে। কিন্তু সেখানে ইংরেজিতে তখন ভালো লেখাপড়ার সুযোগ না থাকায় আমাকে যুক্তরাজ্যের একটা আবাসিক বিদ্যালয়ে পাঠিয়ে দেয়া হয় ১৪ বছর বয়সে। বাড়ি থেকে সেই বের হয়ে যাওয়ার পথটা শুধু এক দিকেই যায়। ঘর ছাড়া ছেলেরা কোনো দিন আর সত্যিকার অর্থে বাড়ি ফেরে না। আর সেই যাত্রাটা ছেলে বা মেয়েদেরকে চিরতরে বদলে দেয়।
তারও একটু আগের কথায় যাই এবার। বাংলাদেশকে চিনতে শিখেছি ছয় বছর বয়স থেকে। ভাবছেন তার আগে কই ছিলাম? আমার জন্ম বাংলাদেশেই ১৯৭২ সনের আগষ্ট মাসে অর্থাৎ স্বাধীনতার প্রায় এক বছর পর। আমাকে গর্বিত বাংলাদেশি বলতে পারেন। কিন্তু এক বছর বয়স থেকে ছয় পর্যন্ত আমার শৈশব কাটে যুক্তরাজ্যের লন্ডনে। আমার বাবা লন্ডনের একটি বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি পড়ছিলেন। মা তখনকার যুগের সাথে তাল মিলিয়ে লন্ডনে চাকরিও করতেন। পাঁচ বছর বয়সের আগে আমার প্রথম ছোট বোন না আসার আগ পর্যন্ত আমি বড় হচ্ছিলাম তাদের এক মাত্র ছেলে হিসেবে এবং ঘরের ভেতর মায়ের মুখ থেকে শোনা কিছু বাংলা শব্দ শুনে। তার সাথে পারিপার্শিকতার ইংরেজি ভাষা ও সংষ্কৃতিই আমাকে বেশি প্রভাবিত করেছিল এবং কথা বলতে শুরু করার পর ঘরে মায়ের মুখ থেকে শোনা কিছু শব্দ ছাড়া ফটফট করে ইংরেজ ছেলেদের মতোই ইংরেজি বলতাম।
আমার বাবা-মা ছিলেন গানের ভক্ত। তারা ঐ পাঁচ বছর লন্ডনের বিভিন্ন ভারতীয় দোকান থেকে খালি বিভিন্ন বাংলা ও হিন্দি রেকর্ড (এল পি) কিনতেন। আমাদের বাসায় সারাক্ষণ সেই গানগুলো বাজতো। কিছু না বুঝলেও সেই গানগুলো শুনতে শুনতে বেশ রপ্ত করে ফেলেছিলাম এবং গুনগুন করে আমার বাবা-মা ও তাদের অন্যান্য বাংলাদেশি বন্ধু-বান্ধবদের শোনাতেও পারতাম। সেই তখন থেকে দূরের বাংলাদেশ ও ভারতের সংষ্কৃতির সাথে আমার পরিচয়। লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে গানের সেই পরিবেশটা বাংলা আর হিন্দির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। বাইরের বিলেতি পরিবেশের সাথে তাল মিলিয়ে তখনকার জনপ্রিয় বিভিন্ন ইংরেজি আধুনিক গানের সাথেও ছিল আমার ভালো সম্পর্ক। “এব্বা”, “কার্পেন্টার্স”, “ক্লিফ রিচার্ড”, এদের গানও বাজতো আমাদের বাসায়। মা এখনো স্মৃতিচারণ করে আমি কীভাবে জোর করে তাদেরকে এব্বা”র গান রেকর্ডে বাজাতে বলতাম। “ইউ আর মাই ড্যান্সিং কুইন”, “নওইং মি, নওইং ইউ” ইত্যাদি ঘুমের মধ্যেও গেতে পারতাম। এখন মনে মনে হাসি যে খেলাধূলার প্রতি আমার একেবারেই মনোযোগ ছিল না অথচ এব্বা’-র গান মুখস্ত করে ফেলেছিলাম এবং ‘কার্পেন্টার্স’-এর “ইয়েস্টারডে ওয়ান্স মোর” গানটা আমাকে আমার স্কুলের শিক্ষিকা সবার সামনে দাঁড় করিয়ে গাওয়াতেন।
ছয় বছর বয়সে ছোট বোনকে নিয়ে আমি আর আমার বাবা-মা দেশে ফিরলাম। সেই পরিবর্তনটা আমার মাঝে সারা জীবনের জন্য দাগ কেটে দেয়। আপনি পৃথিবী থেকে মঙ্গল গ্রহে চলে গেলে আপনার যা অনুভূতি হতে পারে, আমার বোধহয় তাই হয়েছিল। সম্পূর্ণ অচেনা এক জগত যার ভাষা বুঝিনা আর যেখানে সবখানে মানুষ আর মানুষ (বেশির ভাগই আমার আত্মীয় স্বজন)। কিন্তু বাচ্চারা অল্প সময়ের মধ্যেই অনেক কিছু মানিয়ে নিতে শিখে। বুড়াদেরই যত সমস্যা হয়। শুরু হলো এক নতুন অধ্যায়। বাবার কড়া হুকুম ছিল কারো সাথে ফটফট করে ইংরেজি বলা যাবে না। কী মুশকিল! আমি তো বাংলাই বলতে পারি না দুই একটা শব্দ ছাড়া। কিন্তু বাবার হুকুম তো মানতেই হবে। কত মানুষ আমার ইংরেজি শোনার জন্য অস্থির। কিন্তু আমার উপর জারি করা আছে এক বিশেষ আইন। মানুষের কথা শুনে শুনে নতুন শব্দ এবং বাক্যগুলো রপ্ত করা ছাড়া আমার আর কোনো গতি ছিল না। একটু আকটু বলতে শুরু করলে অবশ্য অনেকেই খুশি হত আবার ছোটরা টিটকারিও মারতো।
মানুষে মানুষে ভেদাভেদটা বোধহয় ছয় বছর বয়সে এই প্রথম দেখি। আমার দাদার বাড়িতে ছিল রান্না ঘরে কাজ করে এমন দুইটা ছোট মেয়ে। স্বভাব বশত তাদের সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়ে যায় যদিও কেউ কারো কথা তেমন বুঝতে পারতাম বলে মনে হয় না। আমি রাতে খাবার টেবিলে বসে মাকে জিজ্ঞেষ করতাম যে মেয়ে দুইটা কেন আমাদের সাথে এক টেবিলে বসে খাবার খায় না? এরা তো আমার বন্ধু। টেবিলে বসা সকল গুরুজনদের মুখে তখন খালি অট্ট হাসি ছাড়া আর কোনো আওয়াজ বের হত না। কেউ আমাকে বুঝানোর চেষ্টাও করেনি তারা কেন আমাদের সাথে খাবার খায় না, এক সাথে সোফায় বসে না। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সব বুঝেছি। অভাবের তাড়নায় এরা নিজেদের পরিবার ছেড়ে আরেক পরিবারে এসেছে দাসী হয়ে, নতুন পরিবারটার সমস্ত কাজ কর্ম করতে, নতুন পরিবারটাকে নিজেদের করে নিতে। সেখানে তিন বেলা খাওয়া ও মাথার উপর একটা ছায়া পাওয়া গেলেও সাথে জুটতো আরো অনেক কিছু যা আমাকে এখনো পীড়া দেয়। এদের ছিল না সামান্য মানুষ হিসেবে মর্যাদা। এদের করুণ দশার সুযোগ নিয়ে এদের উপর বিভিন্ন পরিবারেই দেখেছি অমানবিক, মানসিক ও শারীরিক অত্যাচার, যেই অপরাধে বাড়ির গৃহিণী থেকে শুরু করে গৃহকর্তা ও বাড়ির ছেলে মেয়েরাও সংযুক্ত ছিল। শারীরিক প্রহার কাকে বলে জীবনে এই প্রথম তা অবলোকন করি নিজের বাড়িতে। নিজের চোখে দেখা সেই ভয়াবহ দৃশ্য আজও চোখে ভেসে ওঠে। আমার কামনা যে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতির ফলে ভবিষ্যতে দেশের কোথাও আর কোনো কাজের মেয়ে বা ছেলে খুঁজে পাওয়া যাবে না। সবাই আত্মমর্যাদা নিয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করবে বিভিন্ন অফিস-আদালত, বিদ্যালয়, দোকানপাট আর শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে।
আমার বাবা তার নিজের পরিবারের কথা অগ্রাহ্য করে আমাকে বাংলা মাধ্যমের প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি করালেন। সবাই ভেবেছিল যে আমাকে বুঝি ইংরেজি মাধ্যমে ভর্তি করানো হবে। কিন্তু না। বাবার শখ ছিল আমাকে বাংলা শিখাবেন আর তাই বাংলা স্কুল। শুরু হলো আমার বাঙ্গালীয়ানা। বাবার এই সিদ্ধান্তকে আমি আজও সবচেয়ে বেশি সন্মান করি। এটা না হলে আর পরের জীবনে বিদেশে বসে এক গাদা হুমায়ুন আহমেদের বই পড়তে না পারলে আজ ৪৫ বছর বয়সে লন্ডনে বসে এই লেখা আর হয়তো লিখতেই পারতাম না। বাসায় আসলো সাদা-কালো টিভি। শুধু একটি মাত্র চ্যানেল যা এখনো বিটিভি নামে পরিচিত। চ্যানেল একটা হলে কী হবে, তার মধ্যে যে মহিমা ছিল তার সিকিটুকুও এখন খুঁজে পাওয়া যাবে না দেশের সব কটা বেসরকারী ছোট পর্দাগুলোতে। “সকাল সন্ধ্যা”, “এইসব দিন রাত্রি”, “ঢাকায় থাকি”, “আমি তুমি সে” এই সব নামের ধারাবাহিক নাটক সপ্তাহে একবার দেখা ছাড়াও ছিল “মনের মুকুরে”, কিছু উন্নত মানের বাংলা ছায়াছবি ও বিভিন্ন গানের অনুষ্ঠান। আমি সেই ছোট পর্দার মাধ্যমে বাংলাদেশকে চিনতে শিখি। পরিচিত হই সাবিনা ইয়াসমিন, রুনা লায়লা, প্রয়াত ফজলে লোহানী, হানিফ সংকেত আর টেলি সামাদের সাথে।
কেউ কেউ বললো যে আমি গুনগুন করে এত ভালো গান গাই যে আমার গান শেখা উচিৎ। আমার মায়েরও শখ হলো আমাকে একজন প্রশিক্ষিত প্রাণী বানিয়ে ফেলবে যাতে যখন খুশি তখন আমাকে বলবে গান গাও আর আমি গাইতে শুরু করবো। ওমা! গান তো না, একেবারে উপমহাদেশের উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত দিয়ে শুরু। এতে গানের সুর, লয় আর তাল – এগুলো ঠিক মতো বসে যায়। কিন্তু একজন ৭ বছরের বাচ্চা কি এই সব কাঁপানো আওয়াজ গলা থেকে বের করতে চায়? কিন্তু বাবা-মার এই অপ্রিয় চেষ্টার কারণে আমি পরে খুব সহজেই নজরুল গীতি, রবীন্দ্র সঙ্গীত, আধুনিক বাংলা গান, পল্লীগীতি, দেশাত্ববোধক গান ইত্যাদি পরিবেশন করতে শিখি। তবে সেগুলো শিখার আগে প্রথমে বিভিন্ন জায়গায় আমাকে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতও পরিবেশন করতে হত। আর আমি সেই বয়সেই বুঝে গিয়েছি যে সেগুলোর ভক্ত শ্রোতা খুবই কম। সবাই হালকা আর তালের গান শুনতে বেশি পছন্দ করে। কিন্তু আমার বাবা-মা আজ পর্যন্ত জানে না যে সব জায়গায় সব গান গাওয়া যায় না। পরিবেশ আর শ্রোতা বুঝে গেতে হয়। তাদের এই অজ্ঞতার জন্য তাদের উপর আমার অভিমান এখনো কমেনি। তবে গান গাওয়ার পরিবেশ ও শ্রোতা আজ আমার কাছে না থাকা সত্যেও বাংলা, হিন্দি ও উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের মর্ম আজ নিশ্বাসে ও মনের গভীরে অনুধাবণ করতে পারি। আর কোনো এক কালে বিড়ি-সিগারেট দিয়ে গলা প্রায় নষ্ট করে ফেলা সত্যেও আজও দুই একটা গান গেয়ে দিতে পারি দেশে বেড়াতে আসার পর কেউ হাতে পায়ে ধরলে। এই অবদান আমার বাবা-মার।
শুধু গান আর লেখাপড়া দিয়েই কি হয়? ধর্ম লাগবে না? প্রথমে হলো ৭ বছর বয়সে আমার খতনা। সে কী অত্যাচার! ডাক্তার আমাকে কিছুতেই ভালোভাবে স্থানীয় এনেস্থেসিয়া দিতে পারে নি। সেই ব্যথা আর চিৎকার এখনো মনে পড়ে। সেই আক্রমণাত্মক দিনটা উদযাপন করার জন্য এসেছিলেন আমার কিছু আত্মীয় স্বজন। সবাই আমাকে বুঝালো আমি সেই দিন থেকে মুসলমান হয়ে গেলাম। এর আগে কী ছিলাম সেটা প্রশ্ন করার মতো বোধ শক্তি আমার তখনো হয়নি। তারপর বাসায় এলো হুজুর। কেতাব থেকে শুরু করে কোরআন শরীফ। ওমা! হুজুর বললো আমাকে তো নামাজ পড়া শিখতে হবে নইলে বিভিন্ন মুখস্ত করা দোয়া দুরুদগুলো বিফলে যাবে। সেই যে শুরু হলো, একটা সময় গিয়েছে যখন পাড়ার মসজিদে ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়তাম। মসজিদের ইমাম থেকে শুরু করে মোয়াজ্জেন ও অন্যান্য হুজুরদের কী আদর আর ভালোবাসা! এমন কি মসজিদের মাইকে আজানও দিতে পেরেছি দুই একবার।
আমি বোধ হয় দেখতে সুন্দর ছিলাম, নইলে নামাজ পড়তে আসা বিভিন্ন বয়সের যুবকরা আমার দিকে এমন ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকতো কেন? মুচকি মুচকি হাসতো বেহায়ারা। এক হুজুর আমাকে এক জোহরের নামাজের পর তার কক্ষে তার সাথে বিশ্রাম নেয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানালো। আমি কিছুটা কৌতুহল নিয়েই রাজি হলাম। আট-নয় বছর বয়সের ছেলেদের কতই না কৌতূহল থাকে। তার বিছানায় শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করছি, হঠাৎ খেয়াল করি আমার পশ্চাদপদে ব্যথা। আঁতকে উঠে দৌড় দিয়ে ঘর থেকে পালালাম। আর তারপর এই ঘটনাটা কেন জানি একদম ভুলে গেলাম অনেক দিনের জন্য। আজকালকার খবরে মাদ্রাসায় মোল্লা দ্বারা বালক ধর্ষণের কথা বেশ ছড়িয়ে পড়াতে আমার এই ছোট ঘটনাটা কিছু দিন আগে মনে পড়ে গেল। আরো মনে পড়ে গেল কীভাবে একটা না বোঝা ভাষায় তোতাপাখির মতো উচ্চারণ করে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত হুজুরের সামনে কয়েক মাস ধরে কোরআন শরীফ খতম দেয়ার পর বাসায় বসলো এক বিরাট মিলাদ মাহফিল। প্রতিটা আলিফ-বা-তা-সা’র জন্য কিছু কল্পনা করা সোয়াব লাভ করা ছাড়া আর কিসের সান্নিধ্য পেয়েছি বলতে পারেন?
আমি তো কিছু বাছাই করা অনুবাদ ছাড়া তখন কিছুই জানতে পারিনি এই বইটিতে কী লেখা আছে এবং এখানে আল্লাহ’র বাণী আসলে কি? ওয়াজ মাহফিল, পরিবার, ও সমাজ থেকে ভাঙ্গা রেকর্ডের মতো কিছু কথা শুনে শুনে মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল, এই যা। কিন্তু এতেই কি আমি মুসলমান হয়ে গিয়েছেলাম? একটা না জানা ভাষায় একটা বই পড়ার অর্থ কি? বাংলাদেশের মতো বাংলা ভাষার দেশ কেন আরবিতে কোরআন শরীফ পড়ার উপর এতটা জোর দেয়? কেন প্রকৃত অনুবাদ পড়াটাকে যথেষ্ট মনে করা হয় না, কেউ কি ভেবে দেখেছেন? সেই অর্থ বা অনুবাদের সব কিছু আমাদের ভালো নাও লাগতে পারে, সেই সম্ভাবনা কি থেকে যায়? এবং এতে বাংলাদেশে মানুষদের ঈমানের উপর কোনো প্রকার হুমকি আসতে পারে, সেই ভয়েই কি থাকেন মুমিন আলেমগন?
এই প্রশ্নগুলো করার ধৃষ্টতা এমন কি চেতনাও তখন আমার ছিল না। সেটা মাথায় এসেছে বেশ পরে যখন আমি ১৯৮৭-১৯৯১ সাল পর্যন্ত বিলেতের সেই আবাসিক বিদ্যালয়ে পড়ি। সেখানকার এক খ্রিস্ট পাদ্রী আমার কাছ থেকে একবার ভালোভাবে বুঝতে চেয়েছিলেন বাংলাদেশে কেন আমরা আরবি ভাষায় কোরআন পড়ি যার কোনো মানেই আমরা বুঝি না। তারা তো ইংরেজি ছাড়া আর কোনো ভাষায় বাইবেল পড়ার কথা চিন্তাও করতে পারে না। তো আমাদের এই তামাশা কেন? আমি তার কথার কোনো যথাযথ জবাব দিতে পারিনি তখন। কিন্তু মনে প্রশ্নটা ঠিকই গেঁথে যায়, যার প্রকৃত অনুধাবণ যুক্তরাষ্ট্রে আমার পরের দিনগুলোতে ইসলাম ধর্ম নিয়ে আমার ভাবনা চিরতরে বদলে দেয়।
এত গান, নাটক, লেখাপড়া আর নামাজ-কামাজের মধ্যে আমি খেয়াল করলাম যে বাংলা শিখতে শিখতে আমি আমার সেই ছোট বেলার ইংরেজি ভুলে গিয়েছি। আত্মীয় স্বজনদের পক্ষ থেকেও একই কথা জানলাম। কালক্রমে বাংলাদেশের রাজনীতি বড় খারাপের দিকে চলে গেল। আমি টিভিতে জিয়াউর রহমানকে দেখে দেখে বাংলাদেশের আর সব মানুষদের মতো তাকে ভালোবাসতে শিখলাম। তাকে যখন খুন করে ফেলা হলো, তখন বাংলাদেশের শোক দেখে মনে হয়েছে প্রত্যেকের বাবা বা স্বামী মারা গেছে। জিয়ার মতো বিতর্কিত মানুষ যে কীভাবে পুরা বাংলাদেশকে যাদু করে রেখেছিল তার রেশ এখনো কাটেনি। কিন্তু তারপর বন্দুকের ক্ষমতায় এরশাদ সাহেব আসলে আমার বাবা ভাবলেন যে এই দেশে তার আর ভবিষ্যত নেই। আবার সেই বিদেশেই পাড়ি জমাতে হবে। কিন্তু তখন তার তিন ছেলে মেয়ের (আমার আরেকটা ছোট বোন তত দিনে এসে গেছে) ইংরেজির অবস্থা খুব খারাপ। তাই এবার বাংলা মাধ্যম থেকে সোজা ইংরেজি মাধ্যম। আমি সেখানে পঞ্চম শ্রেণিতে ঢুকলাম।
এ কী এলাহি কান্ড! এখানকার ছাত্র-ছাত্রীরা বাঙ্গালীর মতোই দেখতে অথচ দেশে বসে বিদেশি হাল। কেউ বাংলা ঠিক মতো বলতে পারে না। ঢং ঢাং একেবারে কেমন জানি। ভেঙ্গে ভেঙ্গে বাংলা বলে তাও আবার বিরক্তি নিয়ে যদি কখনো দরকার হয়। ইংরেজি বলছে যেটাকে আমি তখন মনে করতাম না জানি কী ভালো মানের। পরে আবার বিদেশে এসে ইংরেজি ভালোভাবে রপ্ত করে অনুধাবণ করলাম যে তারা আসলে তেমন কিছুই ইংরেজি বলতে পারতো না। কিন্তু ঢংটা ঠিকই করতে পারতো। এদের ভাব ছিল এদের জন্মই যেন হয়েছে একটা ভুল দেশে। কোনো রকমে পাস করে আমেরিকা যেতে পারলেই হলো। তখন আর বাংলাদেশ নামের একটা অনগ্রসর দেশের সাথে তাদের কোনো যোগাযোগ রাখার প্রয়োজন থাকবে না। কালক্রমে আমার ব্যাচের প্রায় অনেকেই এখন যুক্তরাষ্ট্রে। এদেরই মা’রা অনেকেই আবার সেই স্কুলের শিক্ষিকা ছিলেন। এদের মধ্যে আমার মা’ও ছিলেন অন্যতম!
এই ইংরেজি মাধ্যমের চ্যাঙরাদের মধ্যে ছিল না আমার মনে তত দিনে গজিয়ে ওঠা দেশপ্রেম ও বাঙ্গালীয়ানা। এরা রবীন্দ্রনাথের নাম শুনেছে মাত্র। এরা ক্যানাডার প্রেইরীর নাম জানে কিন্তু বাংলাদেশের পদ্মা-মেঘনা-যমুনার মোহনার কথা জানে না। এদের ছিল নিজের দেশ ও পরিবেশের প্রতি বিতৃষ্ণা, বাংলা মাধ্যম থেকে আসা আমার মতো খ্যাত ছেলেদের প্রতি অবজ্ঞা। এবার বুঝলাম বাবা কেন আমাকে প্রথমে বাংলা মাধ্যমে লেখাপড়া করিয়েছিলেন। বাংলা ভাষার প্রতি আমার জন্মে গিয়েছিল এক অকৃত্রিম ভালোবাসা। সেই ভিত্তিটি আজ অবধি রয়ে গেছে। যেই দেশের স্বাধীনতার স্থম্ভ হচ্ছে মাতৃভাষার অধিকার এবং যেই দেশে এখনো ঢালাও করে ভাষা দিবস পালন করা হয়, সেখানে সমাজ কী করে এই সব অবাঙ্গাল ও কৃত্রিম ফিরিঙ্গিদের চাষ করার সুযোগ করে দিয়েছে তা আমার বোধগম্য নয়।
মনে রাখতে হবে যে এই বিশ্বায়নের যুগে ইংরেজি হচ্ছে একটি আন্তর্জাতিক ভাষা। ইংরেজদের চাপিয়ে দেয়া উপনিবেশিক হাতিয়ার আর নয় সেটা। তাই বাংলা মাধ্যমেই ভালো ইংরেজি শেখানোর ব্যবস্থা করতে হবে আধুনিক উপায়ে। কিন্তু বাংলাদেশের সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থা রাখতে হবে বাংলার মাধ্যমে, এই সব বানিজ্যিক ও ভাওতাবাজীর টিউটোরিয়াল ও বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় দিয়ে নয়। অবশ্যই প্রচুর চেষ্টায় সকল সরকারি ও বেসরকারি বাংলা মাধ্যমের চেহারা বদলে দিতে হবে যাতে দেশের নব বিত্তবান বাবা-মা’রা মনে করে বসে না থাকে যে টাকা খরচ করে ছেলে মেয়েদেরকে এই সব জায়গায় পড়ালেই বুঝি ভালো শিক্ষা পাওয়া যাবে, ভালো ইংরেজি শেখা যাবে ইত্যাদি। আজকের শহরাঞ্চলের ছেলে মেয়েদের মধ্যে নিজেদের জাত বাড়ানোর আকাঙ্খায় আধা বাংলা ও আধা ইংরেজি মিশিয়ে বাংলিশ, বা ইংরেজি উচ্চারণে ছাগলের মতো বাংলা বলার অভ্যাস রোধ করার এটাই উত্তম উপায়। আজকের ‘বাট-সো’ প্রজন্মের জন্য অভিভাবক, এই সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং গনমাধ্যম দায়ী।
১৯৮৬ সালের জুলাই মাসে দেশের মায়া ত্যাগ করলাম ফিনল্যন্ডের উদ্দেশ্যে যেখানে বাবা জাতিসংঘের একটা গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠানে যোগ দিলেন। সেখানকার কথায় বেশি না গিয়ে চলে আসতে চাই তারও এক বছর পর বাবা যখন আমাকে বিলেতে আবাসিক স্কুলে পাঠিয়ে দিলেন। এই বয়সে ঘর ছাড়া হওয়ার বেদনা যার হয়নি সে বুঝবে না বেদনাটা কতটুকু। তবে এছাড়া আর উপায়ও ছিল না দেশে ফিরে আসতে না চাইলে। তাই জীবন যুদ্ধের জন্য তৈরি হলাম। ভেবেছিলাম শৈশবের সেই দেশ – সব পরিচিতই তো মনে হবে। কিন্তু না! আবাসিক বিদ্যালয়ের পরিবেশের কোথাও আমার শৈশবের ছায়াটা পর্যন্ত পাইনি। পেয়েছি বিষাদময় একটা গন্ডি।
আমার বাবা-মা’র ধারণা ছিল যে এই সব প্রতিষ্ঠানে রাজা-রানীর সব ছেলেরা পড়তে আসে। এবং ভারত উপমহাদেশে আমাদের প্রাক্তন দাসদের মাঝে রেখে যাওয়া ধারণা অনুযায়ী এই সব প্রতিষ্ঠানগুলো যেন বিশ্বের সেরা অধ্যায়ন কেন্দ্র, যেখান থেকে বের হয় পৃথিবীর সমস্ত নেতা, দার্শনীক, কবি সাহিত্যিক, রাজনীতিবীদ, এরা। বাস্তবে কী দেখলাম জানেন? অধিকাংশ ছাত্ররাই ৮০’র দশকে মার্গারেট থ্যাচার আমলের চরম মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে নব্য ধনী হওয়া স্থানীয় কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণির বাবা-মাদের ছেলে পেলে। এদের যে নতুন পয়সা তা এদের কথা বার্তা শুনলেই বোঝা যেত। এদের মুখের ইংরেজি ছিল স্থানীয় গোত্রের (যেটার ইংরেজি শব্দ স্ল্যাং) এবং এদের আচার আচরণে ছিল না কোনো মার্জিত ভাব। এরা ছিল রুক্ষ এবং বিরক্তিকর। আমি একেবারেই খাপ খাওয়াতে পারিনি চারটি বছর। বিষন্নতায় ভুগেছি আর বিবিসি টিভি দেখে, ক্লাসের অধ্যায়ন করে আর বিলেতের তখনকার সনামধন্য পত্রিকা পড়ে দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে ভালো এবং সম্ভ্রান্ত ইংরেজি রপ্ত করে ফেলি যা আমার আশেপাশের অধিকাংশ বিশ্রীদের তূলনায় ছিল অনেকাংশে উন্নত মানের।
এই পরিবেশে বই পোকাদের করা হত উপহাস। এখানে ভালো ফুটবল বা ক্রিকেট খেলোয়ারদের মূল্য ছিল বেশি। এখানে গুন্ডাদের মতো আচরণকারী ও অন্যদের ছোট করতে পারে এমন ছেলেদেরই সুনাম বেশি ছিল। এখানে যে এই ছকে পড়তো না, তার দিনগুলো হত অন্ধকারাচ্ছন্ন। তাহলে আমার কথায় আসি এবার। আমার ইংরেজি প্রথমে ছিল কাঁচা। আমি এদের কথ্যভাষা বুঝতামই না। খেলাধূলা? মনে আছে যে একেবারে ছোট বেলায় এব্বা”র গান গেতাম কিন্তু খেলা বুঝতাম না? বাংলাদেশে বিগত সাত বছরে লুকোচুরি আর হাড়ি-পাতিল ছাড়া আর কিছু খেলতে পেরেছি বলে মনে নেই। পাড়ার আর কোনো খেলা হলে আমি কিছুতেই পেরে উঠতে পারতাম না। না ফুটবল, না ক্রিকেট, না ব্যাডমিন্টন। আর বাংলাদেশে বিগত সাত বছরে বড় হয়েছি বাবা-মার কড়া শাসনে। তারা তাদের ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন অসুখী। আমার বাবার পরিবারের অনেক মানুষ ছিলেন নিম্ন শ্রেণির মানসিকতার, যাদের মানসিক জিম্মি আর নানান বিষয়ে ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপের ফলে তাদের দাম্পত্য জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ। এর ফলে আমার উপর প্রায়ই আসতো মায়ের দিক থেকে অনাকাঙ্খিত প্রহার এবং বাবার দিক থেকে নিরন্তর গলাবাজী। হ্যাঁ! গান-বাজনা, ফুপাতো, চাচাতো ও মামাতো ভাইবোনদের সাথে ভালোবাসার অফুরন্ত মুহুর্ত, সবই ছিল। কিন্তু তার সাথে ছিল ধারাবাহিকভাবে আমার সাথে আমার বাবা-মা’র জানোয়ার সুলভ আচরণ যার প্রায়শ্চিত্ত তারা এখনো করে চোখের পানি দিয়ে।
আমাদের সমাজে প্রচলিত হয়ে এসেছে যে বাবা-মার অবাধ্য না হওয়ার অর্থ তাদের মুখের উপর কথা বললেও শাস্তি। এতে বাচ্চারা অনেক অন্যায় কথা শোনার পরও বোবা হতে শিখে ফেলে। এক পর্যায় কথার জবাব দিতেও ভুলে যায়। ধর্ম আবার এটাকেই সায় দেয় বলে এই নিয়মনীতি প্রতিটা পরিবারে গাঁথা। তার উপর আছে ছেলে মেয়েদের মনের উপরেও অভিভাবকদের কতৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ। বড় হয়েও পেতে হয় তাদের দ্বারা চাপিয়ে দেয়া বিভিন্ন দায়িত্ববোধ ও অনুশোচনা। তাদের সংকীর্ণ কথাবার্তা ও গালাগালি শুনে অনেক বাচ্চারাই বড় হয়ে ওঠে আত্মবিশ্বাস আর নিজের উপর ভরসার অভাবে। অধিকাংশ অভিভাবকরা তাদের নিজেদের বাবা-মা’দের কাছ থেকেও পায়নি ইতিবাচক মনশক্তির দান। এর ফলে অনেকেই দুনিয়াতে হাত-পা ছড়ানোর পর জোর গলায় অন্যের কথা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে শিখেনি। হ্যাঁ, আমাদের সমাজে পারিবারিক বন্ধন আর তার প্রসার প্রশ্চিমা সমাজের চেয়ে অনেক বেশি শক্ত আর ব্যাপক। কিন্তু তা আসে ব্যক্তিগত বিকাশ আর ব্যক্তি স্বাধীনতার প্রতিকূলতা নিয়ে।
বিলেতে এসে দেখলাম আমি তত দিনে ভেঙ্গে পড়েছি। আমি হয়ে গিয়েছিলাম একজন অদ্ভুতস্বভাব ব্যক্তি (ইংরেজিতে যেটাকে বলে একসেন্ট্রিক)। আমি এই জীবন যুদ্ধের জন্য না ছিলাম তৈরি, না ছিলাম শক্ত। সামান্য টিটকারিও সহ্য করার ক্ষমতা আমার ছিল না। ভাষার অদক্ষতা এবং বেড়ের ওঠার সময়কার কড়া শাসনের ফলে কোনো কথার জবাব দেয়ার অনভ্যাসের কারণে আমি সেই পরিবেশে হয়ে গিয়েছিলাম পঙ্গু। তাদের টিটকারিতে আমার প্রতিক্রিয়া দেখে একজন আমাকে জিজ্ঞেষই করে ফেলেছিল আমি ছোট বেলায় অপব্যবহারের শিকার হয়েছিলাম কি না।
তার উপর আশির দশকে বিলাত ছিল বর্ণ ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের জন্য এক বিভীষিকাময় দেশ। তার কিছু আগেকার দশক ধরে ভারত উপমহাদেশ থেকে আগত সকল অভিবাসীদের উপর ক্ষোভ অনেক ইংরেজরা প্রকাশ্যেই প্রকাশ করতো। পাকিস্থানীদের নাম থেকে নেয়া একটা ইংরেজি শব্দ আবিষ্কার করা হয় – “প্যাকি”, যার উচ্চারণ করা হত ঘৃণাত্তক সুরে এবং আমার উপর তা চালিয়ে যাওয়া হত অবিরাম। আমি বাংলাদেশি বা ভারতীয় হলেও এদের চোখে সকল বাদামী রঙের মানুষরাই প্যাকি। আমি এর প্রতিবাদ জানতাম না। মুখ বুঝে সহ্য করতাম এবং মনের ভেতরের অশ্রু মুছতাম। প্রথমে আমার ইংরেজি শুনে এরা হাসতো এবং আমার উপমহাদেশীয় উচ্চারণের তুমুল ব্যঙ্গ করতো। এটা প্রায় অসহনীয় হয়ে গিয়েছিল বলেই জেদ করে দুই তিন বছরের মধ্যে এই সব চাষা-ভুষাদের তুলনায় অনেক বেশি খাস বিবিসি ইংরেজির উচ্চারণ রপ্ত করে ফেলি এবং সেই ভাষার দক্ষতা দেখাতে শিখি। ভাগ্য ভালো যে সেই বয়সে সেটা সম্ভব ছিল। জীবনের শেষ অর্ধেকের দিনগুলোতে তা আর সম্ভব হয়ে ওঠে না।
আমার সাথে ভালো বন্ধুত্ব করে ফেলে একটি ইংরেজ ছেলে যে বাবার কুটনৈতিক চাকরির কারণে বিভিন্ন দেশে বাস করেছে। স্কুল ছুটির সময়ে সে সেই সব দেশেই চলে যেত। তখন তাদের স্থানান্তর ছিল ব্যাংককে এবং আমি বাংলাদেশি বলে সে আমার প্রতি আগ্রহ দেখায়। আর পাঁচ দশটা ছেলের চাইতে আমি তার সাথেই প্রথম থেকে কথা বলতে পারতাম আমার মতো করে। তার মুখের হাসি আমাকে আনন্দিত করতো আর কখন তার দেখা পাবো সেই আশায় বসে থাকতাম। শ্রেণিকক্ষে তার সাথে বসতে পারলে আমার দিনটাই ভালো যেত – বাকি সময়টার বাজে অভিজ্ঞতাগুলো আর গায় লাগতো না। আস্তে আস্তে আমি মানসিকভাবে তার প্রতি ঝুঁকে পড়ি। তাকে নিয়েই থাকতো আমার চিন্তা এবং আসা যাওয়া। বাকিরা আমাকে উপহাস করতো কিন্তু তার মাঝে পেতাম এক স্বর্গীয় শান্তি। তার স্নিগ্ধ কথা আর অমায়িক ব্যবহার আমার মাঝে আনতো উদ্যম এবং উদ্দীপনা। তার উপস্থিতিতে আমার মনের অনেক কষ্ট আর দুঃখ লাঘব হয়ে যেত। আমি তাকে অনুকরণ করতে শুরু করলাম নিজের অজান্তেই। তার মতো করে কথা বলার চেষ্টা করতাম, তার মতো করে হাসি দিতেও দ্বিধা বোধ করতাম না।
তাকে অন্য কারো সাথে হাটতে দেখলে আমার হিংসা লাগতো। ক্লাসে আর কারো সাথে বসলে তো কথাই নেই। বুঝলাম আমি তার প্রতি দূর্বল হয়ে পড়েছি। আমি চেষ্টা করতাম তার কাছ থেকে আরেকটু মনোযোগ পেতে। মজার বিষয় ছিল যে স্কুলটিতে আমার যেমন ছিল এক বর্ণনাতীত পরিস্থিতি, তারও অবস্থা ছিল কিছুটা শোচনীয়। বই পোকা আর কিঞ্চিত আন্তর্জাতিক মানসিকতার বাহক হিসেবে তাকেও বাকিরা ভিন্ন চোখে দেখতো। সে আস্তে আস্তে টের পেল যে আমার সাথে বন্ধুত্ব রাখলে আমাদের আবাসিক স্কুলের তথাকতিত সমাজে তার মান মর্যাদা উন্নয়ন করা সম্ভব নয়। তাই সে আমার বিরুদ্ধে চলে গেল এমনভাবে যা আজও আমাকে কাঁদায়। সে বুঝতে পেরেছিল যে আমাকে কষ্ট দেয়ার সবচেয়ে সহজ উপায় ছিল আমার তখনকার উপমহাদেশীয় ইংরেজি উচ্চারণের ব্যঙ্গ করা এবং আমাকে প্যাকি বলে গালি দেয়া। এইভাবে সে আস্তে আস্তে আমাকে খুঁড়তে শুরু করলো আর এতে আমার জীবন আরো দুর্বিষহ হয়ে উঠলো।
আমি তো তাকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। আমার ১৪ বছর বয়সে সেটাই ছিল আমার প্রথম ভালোবাসা। আমি যে এই ভাবে ভালোবাসতে পারি সেটাই জানতাম না। এই ভাবে কেউ যে ভালোবাসে তাও জানতাম না। সে জানতো কি না তা আজও আমার জানা নেই। স্কুলের প্রায় পুরাটা চার বছর তার বন্ধুত্ব হারানোর বেদনা আমাকে তিলে তিলে ধ্বংস করে। আর সকলের টিটকারি সহ্য করতে পারলেও তারটা পারতাম না। তাকে অন্য ছেলেদের সাথে ঘনিষ্ট বন্ধুত্ব করতে দেখলে আমার ঘুম হারাম হয়ে যেত। কিছুতেই তা স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারতাম না। সে আমার সকল দূর্বল দিকগুলো জানতো এবং সেই জায়গাগুলোতেই আঘাত করতো। আমি আমার মন তাকে এমনভাবে দিয়ে দিয়েছিলাম যে হঠাৎ কোনো একদিন সে আমার সাথে ভালো ব্যবহার করলে আমার জীবনটা যেন ফিরে পেতাম। আর বাকি সময়টা আবার মৃত হয়ে পড়ে থাকতাম। এই চার বছরের সময়টার শেষের দিকেই আমি জীবনে একটি বারের মতো আত্মহত্যার কথা চিন্তা করি।
এখানে বলে রাখি যে “গে” বা “কুইয়ার” শব্দটা ব্যবহার করে অনেকেই অনেককে উপহাস করতো এই পরিবেশে। বিলেত জুড়ে তখন ছিল সমকামভীতির আড্ডা। এই দেশের আইন ও সমাজ ছিল সমকামীদের চরম প্রতিকূলে। কিন্তু আমি কখনই এই শব্দগুলোর মর্ম বুঝতাম না। ‘গে’ বা সমকামীর আসল মানে সম্বন্ধে আমার ছিল না কোনো ধারণা। আমার কপালেও এই অপবাদটা কেন যেন খুব একটা জুটেনি। আমি যে আসলে এই বর্ণনারই একজন প্রতিকৃতি তার উপলব্ধি কিছুতেই তখন আসেনি। আমি ভেবেছিলাম সেই ছেলেটার প্রতি আমার অনুরাগ বয়ঃসন্ধিকালের একটা স্বাভাবিক অধ্যায়। অন্যরাও নিশ্চয়ই এরকম অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যায়। পরে তা আর থাকে না।
কিন্তু আমার চারপাশের নিয়ম যে যথেষ্ট আলাদা, সেটা আমার সহজে বোধগম্য হয়নি। আমার সমবয়সী ছেলেরা মেয়েদের প্রতিই বেশি ঝুঁকে পড়তো এবং তাদের নিয়েই কথা বলতো। আর আমি প্রহর গুনেছি আমার সেই প্রথম ইংরেজ ছেলেটির সাথে একত্রিত হবার কল্পনায়। স্বপ্নে দেখতাম আমাদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তগুলো। বাকি ছেলেরা প্রায়ই দল মিলিয়ে দুই-তিন থেকে চার-পাঁচ জনের সাথে একত্রে বন্ধুত্ব করে ফেলতো। কিন্তু আমার সুচারু নজর গিয়েছে শুধু একটা একটা করে ছেলে প্রতি। আর তাও আবার অনেক গভীরের তলদেশে। এর পরেও দুই তিন জনের প্রতি আমার কিছুটা অনুরাগ জন্ম নিয়েছিল এবং কষ্টও পেয়েছিলাম। কিন্তু প্রথম প্রেমের আঘাতের ফলে আমি মানসিকভাবে নিজেকে আগের মতো আর দূর্বল হতে দেইনি।
১৯৯১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আমি বাবা-মাকে বিদায় জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দেই বিলেতের প্রতি ঘৃণা বহন করে ও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে যে সেই দেশে আমি আর কোনো দিন ফিরবো না। আমেরিকায় যাই মিশিগান অঙ্গরাষ্ট্রের একটা নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নের জন্য। আহ! নেমেই দেখি কী শান্তির বাতাস। এই দেশের পরিবেশ আর মানুষ যেন প্রকৃত অর্থেই ফেলে আসা বিলেতের চেয়ে অনেক মধুময়। আমি তখন অনেক কষ্টে রপ্ত করা খাস বিবিসি ইংরেজি উচ্চারণ করি যার প্রতিধ্বনি শোনা মাত্র মার্কিনিরা ছাগলের বাচ্চার মতো গদগদ হয়ে যেত। আমার খটকা লাগলো যে ইংরেজ হারামিরা মার্কিনি ইংরেজি সহ্য করতে পারে না, অথচ মার্কিনিরা কী রকম লালা ফেলতে থাকে উল্টাটা শুনলে। এতেই আমি আমেরিকানদের উন্নত মানসিকতার পরিচয় পেতে শুরু করি। আমার বিবিসি মার্কা মুখ খোলা মাত্রই মানুষ আমার সাথে কথা বলতো আর বন্ধু হয়ে যেত। আমি সকলের ঘৃণার পাত্র থেকে পরিণত হয়ে গেলাম সকলের মধ্যমণি। অতীতকে ভুলে গিয়ে নতুন জীবনকে স্বাগত জানালাম মুক্ত আলিঙ্গন করে। আর তার পরের ১২টি বছর ছিল আমার জীবনে সবচেয়ে আনন্দময় কিন্তু একই সাথে তীব্র অভিজ্ঞতা সম্পন্ন।
বিলেতি আর মার্কিনিদের মধ্যে সবচেয়ে বড় পার্থক্য হলো পরের জনরা মনে যা করে, মুখে সেটাই বলে। সেখানে আর কোনো রহস্য থাকে না। ইংরেজরা প্রায়ই ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে এবং আসল কথায় না গিয়ে জিলেপির প্যাঁচ দিয়ে কথা বলে। তাদের মনের আসল কথা বোঝা দায়। তাদের আঞ্চলিক ভাষার অচেনা ইংরেজি এবং বিলেতের শ্রমিক শ্রেণির বাজে ইংরেজি আরো বোঝা যায় না। আমেরিকানরা দেখলাম একেবারেই বিপরীত। তারা সহজ সরল ইংরেজিতে অল্প কথায় এবং কিছুটা অলসতার সাথে মনে যেটা আসে সেটা সরাসরি বলে দেয়। এতে মানুষটা আমাকে পছন্দ করেছে কি করেনি সেটা সহজেই বুঝে নেয়া যায়। আমার কী আনন্দ। আমি মনের মতো মানুষ পেলাম। ইংরেজদের বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না আর আমেরিকানরা গড়গড় করে বলে দেয় নিজেদের কথা। আমার আসলেই মনে হলো আমি বুঝি আমার নিজের বাড়িতেই এলাম। মার্কিনিদের এই স্বভাব আমাকে এতটাই মুগ্ধ করেছে যে আমি আজও তাদেরকে ভালোবাসি।
মার্কিনি পররাষ্ট্রনীতি এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উপর সেটার প্রভাবের সাথে এই সব মানুষদের কোনো যোগাযোগ নেই। এরা নিরীহ মানুষ যারা নিজের জীবন অতিবাহিত করা নিয়ে ব্যস্ত এবং অধিকাংশরাই সেই সময়ে বিদেশিদের প্রতি বিদ্বেষ বা বিদেশাতঙ্কে ভুগতো না। বলা বাহুল্য যে আমি সামনের ১২টা বছর বিলেতিদের নিয়ে একটাও ভালো কথা বলিনি। মার্কিনিদের সাথে তুলনা করে বিলেতিদের মনে হয়েছে নিকৃষ্ট মানের কীটপতঙ্গ। আমেরিকানদের নিয়ে রাজা-উজির মারার অভ্যাস তাদেরই যারা কোনো দিন যুক্তরাষ্ট্রে আসেনি বা থাকেনি। বিলেতের শ্রমিক শ্রেণি ও অতি বামপন্থী আঁতেল থেকে শুরু করে বাংলাদেশের মোল্লা, বুদ্ধিজীবি, ওয়ার্কাস পার্টির সদস্য, সবাই আমেরিকানদের বাঁশ দিতে চুলকানি বোধ করেন দিন রাত। তবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বের হয়ে আসা গান-বাজনা, চলচিত্র, কাপড়-চোপড়, জীবন ধারা, খাওয়া-দাওয়া (ফাস্ট-ফুড) এগুলো অনুকরণ করতে তেমন দ্বিধা বোধ করেন না তারা। আবার তাদের অনেকেরই ছেলে মেয়েরা আমেরিকায় লেখাপড়ার উদ্দেশ্যে দেশান্তর। এই হলো ভন্ডামীর সুন্দর একটা নিদর্শন।
এন আরবার শহরের ইউনিভার্সিটি অফ মিশিগানের ক্যাম্পাসে হঠাৎ একদিন দেখলাম “সমকামিতা সচেতনতা সপ্তাহ” চলছে। কী অদ্ভুত ব্যাপার! বিভিন্ন আবাসিক দালানগুলোর ভেতরের দেয়ালে কিছু ছবি টাঙ্গানো যেখানে দেখা যাচ্ছে দুই পুরুষের অন্তরঙ্গ মুহূর্ত। অনেকটা যৌনাচারের ছবির মতো। আমি কিছুতেই সেগুলো থেকে আমার চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। জীবনে এই প্রথম এরকম কিছু দেখলাম। এর আগে নারী-পূরুষের যৌন ছবি অনেক তো দেখেছি, কিন্তু এই রকম আনন্দ আর উৎসাহ লাগেনি। কিছু দিন এটা নিয়ে আর ভাবিনি। কিন্তু ঘটনাক্রমে একদিন ছাত্র-ছাত্রিদের একটি বাসায় একটি পার্টিতে উপস্থিত হই যেখানে বেশ কিছু সমকামী ছেলেরাও ছিল। তারা আমাকে দেখেই বুঝে ফেললো আমি খুব সম্ভবত তাদেরই একজন – অথচ আমি তার কিছুই জানতাম না। অনেক পরে জানলাম আমার কিছু হাস্যকর কথা তাদেরকে এই ব্যাপারে নিশ্চিত করে দিয়েছিল। আমার সেই কথাগুলো তারা এখনো মনে রেখেছে। আর সেই রাতেই এক সুদর্শন মার্কিনি ছেলের সাথে আমার হলো জীবনের প্রথম চুম্বনের অভিজ্ঞতা। এর আগে কিছু মেয়ের সাথেও তা হয়েছিল। কিন্তু সেই রাতের অনুভুতির তুলনায় সেগুলো ছিল একেবারেই যান্ত্রিক। বুঝিওনি যে আসল চুম্বন কখনোই যান্ত্রিক হয় না। তা হয় শরীর ও মনের পুলকিত ডানা মেলে দিয়ে, যৌন অনুভুতির মধুর সুরে।
সেই অভিজ্ঞতার কথা এখনো ভুলিনি। ছেলেটার সাথে বন্ধুত্ব থেকে যায় কিন্তু আমার মাথায় পড়া বাজ সামলানোর শক্তি আমার ছিল না। এটা কী হলো? আমি এত দিন যা জানতাম তার সবই তো উলটে পড়ে এলোমেলো হয়ে গেল। নিজে ছেলে হয়ে আরেকটা ছেলের সাথেকার অন্তরঙ্গ মুহূর্তটা এত জীবন্ত ও পরিপূর্ণ মনে হলো কেন? আগে দুই একটা মেয়েদের সাথে একই ধরণের সময়গুলো এত সুন্দর তো ছিল না? বরং পরে বিরক্তই লেগেছে। আমি কি তাহলে তাই? বিলেতের আবাসিক বিদ্যালয়ে সবাইকে “গে” বলে যে টিটকারি মারা হত, আমি কি তাদেরই একজন? এই কি আমার আসল রূপ? এ তো অসম্ভব! আমি তো একজন বাংলাদেশি, তার উপর মুসলমান। আমরা তো এসব হতে পারি না। বাংলাদেশের কোথাও তো এই ধরণের মানুষ নেই। আমার মতো আর আট-দশ জন বাঙ্গালী তো এই রকম হয় না। সবাই একদিন একটা মেয়েকে বিয়ে করে, কেউ কেউ আগেই তাদের সাথে প্রেম করে। এই তো শিখেছি। একদিন আমিও তো তাই করবো। বিয়ের বয়স হয় নি, তাই কোনো যৌন অভিজ্ঞতাও হয় নি। কিন্তু এটা আবার কী হলো?
আমি আগামী কয়েকটা মাস ভীষণ মানসিক যন্ত্রণায় ভুগতে লাগলাম। কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না আমার এই পরিণতি। লেখাপড়ার চাপ আর এই চিন্তায় জীবন থেকে সুখ শান্তি সব চলে গেল। আমি কার কাছে আমার মনের কথা বলবো? আমি আমেরিকান ছেলে মেয়েদেরকে বলতে পারি। কিন্তু তারা কি আমার মনের ভেতরের দ্বন্দ্বটা বুঝবে? আমি বাংলাদেশি ছেলে। যতই ফটফট করে বিলেতি সুরে ইংরেজি বলে তাদের মন জয় করি, ভেতরে আমি কাঁনছি, বেদনায় ফেটে যাচ্ছি। তার প্রতিফলন দেখতে পারছিলাম যে আমি বিভিন্ন পার্টিতে অন্যদের তুলনায় অতিরিক্ত মদ ও বিয়ার জাতীয় জিনিষ সেবন করছি। সে আরেক ইতিহাস। রক্ষণশীল মনোভাব নিয়ে বড় হয়ে ১৮ বছর বয়সে যখন কিছু হারামি বন্ধুদের চাপে পড়ে প্রথমবারের মতো একটু এলকোহল মুখে দেই, দেখলাম কিছু পরে মন থেকে আমার সারা জীবনের গ্লানী কমতে লাগলো। কিছু দিন পর নিজ থেকেই আরেক পার্টিতে গিয়ে আরেকটু খেলাম। নিজের ভেতরের চাপা নানান ক্ষোভ ও আত্মবিশ্বাসহীণতা কেটে গিয়ে পেলাম এক নতুন মন ও চরিত্র। এখানে আমি সর্বশক্তিমান ও সব কিছু জানে যে, সেই মানুষটা।
জীবনের এক সময়ে যারা এলকোহলের নেশায় আক্রান্ত হয়ে যায়, তাদের অনেকের মুখ থেকেই এই ধরণের প্রথম অভিজ্ঞতার কথা শোনা যায়। তাদের জীবনে ছিল অনেক চাপা কষ্ট। কিন্তু মদের কোলে তারা পেয়েছিল শান্তি ও শক্তি। সকল প্রকার মদ জাতীয় বস্তু এবং সেটাকে ঘিরে সকল সামাজিকতা ও কর্ম আমার জীবনের পরবর্তি ২৫ বছরকে ঘিরে রাখে। মদ ছিল আমার নিত্য দিনের সঙ্গী। একে ছাড়া আর কোনো কিছু করা ছিল চিন্তার বাইরে। এক সময়ে মদ ছাড়া আমার জীবনে আর কিছুই ছিল না। আসলেই সব হারাতে বসেছিলাম। আজ আমি মদ মুক্ত হয়েছি “এলকোহলিকস এনোনিমাস”-এর সাহায্যে। এটা বিশ্বজুড়ে একটি খ্যাতনামা সমাজ সেবা প্রতিষ্ঠান। আজ লন্ডনে এদের কারণে আমি ফিরে পেয়েছি আমার নিজের সত্বাকে। নিজের স্বাভাবিক আত্মবিশ্বাস আর শক্তিকে। এগুলো অনুভব করতে এখন আর মদের আশ্রয় নিতে হয় না আমাকে।
তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই দিনগুলোতে মদ খেয়ে যে সদ্য আবিষ্কার করা যৌন প্রবৃত্তির কষ্ট ভুলে থাকার চেষ্টা করতাম, সেই বিষয়ে আমার এখন আর সন্দেহ নেই। পড়ালেখার ক্ষতি আমি এই অজুহাতে পার করে দেই। কিন্তু পাঠকদের কাছে আমার বিনীত সতর্কীকরণ। যারা দুঃখ কষ্টে বড় হয় এবং ভেতরে অনেক চাপা বেদনা লুকিয়ে রাখে, তারা মদ ও মাদকের প্রতি ঝুঁকে আসক্ত হয়ে যাবার বাড়তি ঝুঁকিটা রাখে। বাংলাদেশে অল্প বয়সী অনেকেই এখন বিভিন্ন উপায়ে মদ জাতীয় জিনিষ সেবন করে থাকে আর মুহূর্তের জন্য হলেও তাদের দৈনন্দিন জীবনটা ভুলে যায়। এটার মোহ বড়ই শক্তিশালী। সীমিত পরিমানে এলকোহল সেবন করলে তেমন বিপদের সম্ভাবনা নেই। কিন্ত লাগামছাড়া হয়ে যাওয়ার অভ্যাস হয়ে গেলেই কেউ না কেউ আসক্ত হয়ে বাকি জীবনের সকল স্বপ্ন ও সুখ বিসর্জন দিয়ে ফেলতে পারে।
যুক্ত্ররাষ্ট্রে ২২ বছর বয়সে আমার প্রথম প্রেমের সম্পর্ক হয় এক ছেলের সাথে যেটার মেয়াদ ছিল মাত্র দেড় মাস। দুই জনই ছিলাম এই বিষয়ে অনভিজ্ঞ, তাই কী জটিল অবস্থা।! কেউ কিছুই জানতাম না। খালি বুঝতাম যে একজনের প্রতি আরেক জনের প্রচুর আবেগ। কিন্তু আমাদের সামনে ছিল না কোনো রূপরেখা। কীভাবে এটা নিয়ে আগাতে হয়, কীভাবে শারীরিক আনন্দ দিতে ও নিতে হয় তাও না। মার্কিনি এই ছেলেটা পরে নিজেই অনেক বিভ্রান্ত হয়ে আমাকে বললো যে আমরা বন্ধু হলে ভালো হয়। মনের সেই দাগ এখনো কাটেনি। তবে বহু কান্নাকাটির পর তার স্নিগ্ধ হাসির কথা মনে করে আমিও মৃদু হাসতে শুরু করি। তার দুই তিন মাস পর সমকামীদের মানসিক সমর্থন ও আড্ডা খানায় আরেকটি বাচ্চা চেহারার মার্কিনি ছেলের সাথে প্রথমে বন্ধুত্ব, তারপর কিছু শারীরিক আনন্দ আর তারপর প্রেম। হ্যাঁ! অনেক সমকামীদের ক্ষেত্রেই প্রেম শারীরিক মিলনের পরে হয়, আমেরিকাতেও তাই, বর্তমানে বাংলাদেশেও তাই। অথচ সমাজ আমাদের শিখিয়েছে যে আগে প্রেম, তারপর বিয়ে, তারপর যৌনাচার। কী অবাস্তব ব্যাপার! বিয়ের পর যদি দেখি আমরা যৌনচারের ক্ষেত্রে একে অপরের জন্য শারীরিক ভাবে উপযুক্ত নই, তখন?
সেই সম্পর্কটা চললো ছয় মাস। নিজের যৌনতা আর সমকামী হয়ে আসল সত্বা উপভোগ বোধহয় জীবনে এই প্রথম করলাম। এটা ছিল বড়ই শান্তির আর নিজের জীবনের উপর আস্থা সৃষ্টিকারী। ছয় মাস পর তার কিছু ব্যক্তিগত সমস্যায় আমাকে আর জর্জরিত না করতে সেই সম্পর্কটা ভেঙ্গে দিল। আমি কেন যেন বেশি কষ্ট পেলাম না। আমাকে এত সুন্দর করে বুঝিয়ে দিয়েছিল যে তার উপর কোনো ক্ষোভ জমা রাখতে পারিনি। তার কিছু পর আমার চেয়ে বয়সে বড় আর লম্বা এক মার্কিনি ভদ্রলোক আমাকে অনেক কষ্টে পটিয়ে ফেললো। আমার মধ্যে কী দেখেছিল সেই জানে। তার সাথে তিন মাস খুব আনন্দে কাটলো। আমি তখন তার আদরের পুতুল যা নিয়ে সে খুব গর্ব করতো সবার সামনে। কিন্তু হায়! আমার তো এমন কাওকে তেমন পছন্দ না যে আমার চেয়ে বড় এবং লম্বা। এটা বোঝার পর আমি কিছুতেই এই সম্পর্ক মেনে নিতে পারছিলাম না। মনে কোথায় যেন একটা খুঁতখুঁতে ভাব লেগেই থাকতো। তাই আমি নিজের কাছে সততা বজায় রেখে তার সাথে সম্পর্কটা ছিন্ন করে ফেললাম।
তারপর নিজের এক ঘনিষ্ট বন্ধু যার সাথে আমি এক বছর একটা কামরা ভাগ করেছিলাম, এরকম একজনের প্রেমে আমি মশগুল হয়ে পড়ি। কিন্তু এই অনুরাগ কোনো দিন ফেরত আসেনি। আমাকে সে সেই ভাবে দেখতো না। কিন্তু আমি তার মতো হতে শুরু করলাম। তার মতো করে কথা বলতে লাগলাম, তাকে অনুসরণ করতে লাগলাম। ব্যাপারটা একটা অস্বাভাবিকতায় পরিণত হয়ে গিয়েছিল। আর তখনই এলকোহল আমাকে আরো বেশি গ্রাস করে ফেলে। আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলি। ভুলে যাই আমি কে। আমার ঘনিষ্ট বন্ধুরা আমাকে দেখে ভয় পেয়ে যায়। তারা বুঝে উঠতে পারেনি আমি এই ছেলের মাঝে কী এমন দেখলাম। আর সে যখন অন্য ছেলেদের সাথে শয্যাইত হত বা সম্পর্ক করতো, আমি মনের ভেতর মরে গিয়ে একাকার হয়ে যেতাম। এই বিষ হজম করার ক্ষমতা আমার ছিলা না।
এক বছর পর এই অবস্থার অবসান হওয়ার পরপরই এক বন্ধুর বাসায় দেখা পেলাম এক সুদর্শন মার্কিনি যুবকের যে আমাকে বেশ পছন্দ করে ফেললো। আমিও তার প্রতি কিছুটা আকৃষ্ট হয়ে গেলাম তার সুন্দর বচন আর রূপ দেখে। এখানে বলে রাখি যে মদ জাতীয় জিনিষ এই ধরণের সব পরিবেশেই উপস্থিত ছিল এবং বিভিন্ন সমকামীদের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা শুরু হত এবং এখনো হয় কিছুটা মদ সেবন করার পর। সেই রাতে আমি তার বাসায় উপস্থিত। পর দিন সকাল বেলা শুরু হলো ছয় বছর ব্যাপী এক অভিযাত্রা যেটাকে আমি বলবো আমার এখন পর্যন্ত সব চেয়ে লম্বা, জটিল আর আমার উপর সবচেয়ে প্রভাব ফেলা একটি সম্পর্ক। আমরা প্রায় ছয় বছর একত্রে বাস করি একটি যুগল হিসেবে। সাথে ছিল তার বিড়াল যেটাকে আমিও ভালোবেসে ফেলি। সেই সম্পর্কে আমি তার কাছ থেকে শিখতে পারি পশ্চিমা উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত, ফরাসী খাবার (যা ছিল তার প্রিয়), কিছু দার্শনিক চিন্তাভাবনা আর সাথে সাথে কিছু নাস্তিকতার ধারণা যা আমি তখন একেবারেই পছন্দ করতাম না। আর আমার কাছ থেকে সে শিখে বাংলাদেশ সম্বন্ধে, তার ছোট গন্ডির বাইরের দুনিয়ার সম্বন্ধে। একে অন্যকে অনেক কিছু শিখিয়ে আর নিজেও শিখে আমাদের মধ্যে ছিল এক সুন্দর আধ্যাতিক সম্পর্ক।
হ্যাঁ, শারীরিকভাবে আমার চাহিদা যেটা চাইতো, সে সেটার অনেকখানিই ছিল। তাই আমাদের সম্পর্কে সেখানেও ছিল এক যাদু। কিন্তু এখানে দূরের কিছু কালো মেঘ ছিল যা আমি আগে টের পাইনি। সে ছিল মদের প্রতি আসক্ত। এই আসক্তিতে সে ছিল জর্জরিত এবং কোনো এক ক্ষোভ বা কষ্ট তার ভেতরে চাপা ছিল যা আমি আজও সঠিকভাবে উদঘাটন করতে পারিনি। ক্রমে ক্রমে তার এই আসক্তি আমাদের সম্পর্কটাকে বিষাক্ত করে ফেলে এবং আমিও দেখলাম যে জীবনে প্রথমবারের মতো আমিও প্রতিটি দিন অল্প করে হলেও এলকোহল সেবন করছি। এর আগে কখনই এটা দৈনন্দিনের ব্যাপার ছিল না। প্রিয় পাঠকদের উদ্দেশ্য করে বলছি যে প্রতিদিন মদ সেবন করা হচ্ছে বিপদ সংকেত।
ছেলেটার সাথে সম্পর্ক শুরু হওয়ার প্রথম দিনগুলোর দিকে আমি মিশিগান অঙ্গরাষ্ট্রের অনেক বাংলাদেশিদের সাথে পরিচিত হই এবং তাদের বিভিন্ন সাংষ্কৃতিক অনুষ্ঠানে আমার ডাক পড়তো। ছোট বেলার সেই গানের গলা তখন ভালোই ছিল এবং তাদের অনেকের সাথে আমার হয়ে যায় ঘনিষ্টতা। কিন্তু সেই সব অনুষ্ঠানের পর আমি ফিরে আসতাম আমার মানুষটার কাছে যার কথা আমি বাংলাদেশিদেরকে বলতে পারতাম না। এই চাপা কষ্ট আমাকে আস্তে আস্তে গ্রাস করে ফেলে। আমাকে তারা একটা বাংলাদেশি সমিতির প্রশাসক হতে বলেছিল যা আমি গ্রহণ করিনি নানান অজুহাতে। সেই সম্পর্কে থাকা কালীন আমি এটাও খেয়াল করলাম যে আমার বাবা-মা ও বোনদের সাথে আমার হয়ে গিয়েছে এক বিরাট দূরত্ব। তারা ততদিনে ফিনল্যান্ড ছেড়ে যুক্তরাজ্যের উত্তর আয়ারল্যান্ডে এসে পাড়ি জমিয়েছে। আমার মনের ভেতর কামড়াতে থাকলো যে আমি আমার যেই যৌনপ্রবৃত্তি আর সম্পর্কের কথা এত দিন তাদের কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছি, তা মুখ ফুটে বলার সময় হয়ে এসেছে। আমার বয়স তখন ২৭। প্রতিটি সমকামীর জীবনে এই মুহুর্তটা আসে মরুভূমির এক ঘন বালুঝড়ের মতো।
কেউ হয়তো ভাববেন এগুলো বলার দরকার কি? যেমন আছে তেমন থাকলে ক্ষতি কিসের? ক্ষতি অনেকগুলো। প্রথমত, ততদিনে আমি আমার যৌনতা নিয়ে বিভক্তি কাটিয়ে উঠে একটি আস্থা সম্পন্ন ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছি। এটা অন্তত আমার মার্কিন সমাজের চোখে। কর্মক্ষেত্র ও বন্ধু-বান্ধবদের কাছে আমি ছিলাম একজন আত্মসন্মান বিশিষ্ট সমকামী ব্যক্তি। একই সঙ্গে আমার ছিল একটি ছেলের সাথে দীর্ঘ সম্পর্ক। সমস্যাটা দেখা দিল সেখানকার বাংলাদেশিদের নিয়ে, আমার বাবা-মাকে নিয়ে ও বাংলাদেশে আমার কোনো ভবিষ্যত নিয়ে। নিজের দেশের সাথে আমার হয়তো কোনো দিন আর সম্পর্ক থাকবে না। কিন্তু নিজের বাবা-মা সাগরের ঐ পাশেই থাকেন এবং তাদের কাছে এত বড় মিথ্যা নিয়ে আর বেঁচে থাকতে পারছিলাম না। আমার এই গোপনীয়তার জন্য তাদেরকে দূরে ঠেলে দিচ্ছি, এই অপরাধবোধ আমাকে শেষ করে ফেলছিল। এরপর হয়তো ভাববেন বাবা-মা যদি এত কিছু জানার পর আমাকে ত্যাজ্য করে দেয়? হ্যাঁ, সেই ভয় আমার যথেষ্ট ছিল এবং কিছুতেই নিজেকে প্রস্তুত করতে পারছিলাম না এই ভয়াবহ কাজটা করতে। কিন্তু এটা যে সম্পন্ন করতে হবে সেই ব্যাপারে আমি ছিলাম নিশ্চিত, এর পরিণাম যাই হোক না কেন। আমি কী, তা তাদেরকে জানতেই হবে। কারণ তারা আমার পিতা-মাতা।
এই ভয়াবহ কাজটা করলাম একটি লম্বা চিঠি লিখে ও তারা সেই চিঠি পেয়ে পড়ার সময়ে তাদেরকে ফোন করে। সে কী বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা। আমি মদের ঘোরেই কেঁদে কেঁদে কথা বলেছি। তাদেরও কান্নার আওয়াজ ভেসে আসলো ওই পার থেকে। জানলাম যে তারা আমার এই ব্যাপারটা জানতেন। নিজেদের মধ্যেই আলাপ করে তারা এই ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছেন অনেক দিন আগে। কিন্তু তারা সেটা আমাকে জানতে দেননি আর আমার বোনদেরক বলে দিয়েছিলেন আমাকে বলতে যে আমি যেন কথাটা মুখ ফুটে তাদেরকে কোনো দিন না বলি। তারা আমার কাছ থেকে কথাটা শুনতে চাননি। আমি বোনদেরকে আমার কথা আগেই বলেছিলাম। আমার বোনরা আবার আমাকে কখনো বলেনি যে বাবা-মা জানেন এবং তাদেরকে আমার এটা বলা নিষেধ। কিন্তু মা আমাকে তখন ঠিকই বলে ফেললো যে তাদেরকে বলে আমি হয়তো কাজটা ঠিকই করেছি।
সেই থেকে শুরু হলো আরেকটা লম্বা যাত্রা যেখানে আস্তে আস্তে আমার পিতা-মাতা আমার জীবনে আবার ফিরে এলো দূর থেকে হলেও। আস্তে আস্তে সব মিথ্যা কেটে যেতে আরম্ভ করলো। এখন আমাকে নিয়ে তাদের কাছে আর কোনো রহস্য নেই। তাদেরকে নিয়ে আমার মাঝেও নেই কোনো রহস্য। আমার মার্কিনি পারিক যে কেবল বন্ধু নয়, সেটা বলতে আর ভয় লাগলো না। আর একটা অদ্ভুত অনুভূতি টের পেলাম কিছু দিনের মধ্যেই। আমি এত দিন ছিলাম একটি বিভক্ত মানুষ। বাইরের দিক থেকে আমি ছিলাম মার্কিনি হতে চায় এমন একজন সমকামী পুরুষ। আর ভেতরে ছিলাম একজন বাঙ্গালী যে তখনও নিজেকে মুসলমান ভাবতো (শুধু নামে, কর্মে নয়)। এবং কিছুতেই এই দুই মানুষের মিলন কোনো দিন হবে বলে আমার ধারণা ছিল না। এইভাবে বিভক্তির ভেতর দিয়েই বুঝি বাকিটা দিন কাটিয়ে দিতে হবে। কিন্তু না! বাবা-মার কাছে এই কঠিন কাজটা করে ফেলার পর মনে হলো কাঁধ থেকে বিরাট একটা বোঝা উঠে গেল আর আমার সেই দুইটা মানুষ আবার এক হয়ে বলতে লাগলো আমি একজন বাংলাদেশী সমকামী।
বাবা-মা’র মন নরম ও স্বাভাবিক হতে আরো অনেক বছর লেগে যায় কিন্তু সেটা ক্রমান্বয়ে হয়েছে তার নিজের গতিতে। ছেলের এই জীবন আপাত দৃষ্টিতে মেনে নেয়া আর সেটার মর্ম সত্যিকারভাবে অনুধাবণ করে গ্রহণ করে নেয়ার মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ। তাদের দোষ দেই কীভাবে? তাদের কি ছিল অন্য বাবা-মাদের সাথে কথা বলে এই ব্যাপারটা বুঝে নিতে, সহায়তা পেতে? তাদের কি ছিল একটি অনুকূল পরিবেশ যেখানে অনেক বাবা-মা’দের সন্তানরাই প্রকাশ্যে সমকামী? এখন ভাবলে বিশ্বাসও হয় না যে ১৯৯০ দশকে তখনো পশ্চিমা দুনিয়া ছিল যথেষ্ট ভিন্ন। আমি যেমন আমার ছাত্র পরিবেশে পেয়েছি অঢেল সমর্থন, তারা পেয়েছেন শুন্য। হয়তো তারা অসহায়ও বোধ করেছেন এই ব্যাপারে। কিন্তু আজ তারা সব মেনে নিয়েছেন আমাকে সময়ের সাথে আরো ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে ও আমাকে আবার নতুন করে জানতে পেরে। আর আমিও সেই সাথে তাদের প্রতি আমার ছোট বেলার ক্ষোভের কথা প্রায় ভুলে গিয়েছি। আমি এখানে ভাগ্যবান কারণ আমার বাবা-মা কিছুটা শিক্ষিত এবং তারা পশ্চিমা দুনিয়াতে অনেক দিন ধরে বাস করছেন। কিন্তু আমার মতো কি আরো বাংলাদেশি আছে যাদের কপাল এতটা ভালো নয়?
সেই থেকেই আমার এক নতুন উদ্দীপনা এলো আমার মতো বাংলাদেশি সমকামীদের খুঁজে বের করে তাদের সাথে যোগাযোগ করতে। বাংলাদেশে আন্তর্জাল এসেছে তখন বেশি দিন হয়নি। কিন্তু সেই নেটে তত দিনে ইয়াহু গ্রুপ হয়ে গিয়েছে বাংলাদেশি সমকামীদের ঘিরে। আমি হতভম্ভ যে আমার মতো আরো কিছু ছেলেপেলে আছে যারা বাংলাদেশে বসেই একজন আরেকজনের সাথে কথা বলছে, আত্মপ্রকাশ করছে, নিজের আনন্দের কথা বলছে, দুঃখের কথা বলছে আর যৌন অভিজ্ঞতার জন্য একজন আরেকজনের সাথে দেখা করতে চাচ্ছে। আমি পেলাম নতুন এক অনলাইন জীবন। আমি ভেবে বসেছিলাম যে সারা দুনিয়ায় আমিই বুঝি এক মাত্র বাংলাদেশি সমকামী ছেলে। নিজের দেশের সাথে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাবে, এই কষ্টেই আমি এত দিন মরছিলাম অথচ অনলাইনে আবার দেশের সাথে যোগাযোগ শুরু হলো। বাংলাদেশের অনেকগুলো দৈনিক পত্রিকাগুলোর আন্তর্জাল সংষ্করণও তত দিনে বের হয়ে গিয়েছে। কাজেই ২০০১-২০০৬ সালের মধ্যে বিএনপি-জামাত শাসনামলে বাংলাদেশ কীভাবে একটি জঘন্য দূর্নীতিবাজ আর সন্ত্রাসবাজ রাষ্ট্রে পরিণত হয়ে গিয়েছিল তা আমার ছোট মার্কিনি শহরে বসে ও ২০০৩ সালের মার্চ মাস থেকে লন্ডনে বসে পরোক্ষভাবে দেখেছি।
২০০১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ১১ তারিখে যুক্তরাষ্ট্রের উপর এলো এক অনাকাঙ্খিত, অপ্রত্যাশিত ও জগন্য আক্রমণ। আরব জঙ্গিরা বিমানে চড়ে নিউইয়র্ক শহরের দুইটি সব চেয়ে উঁচু দালান, রাজধানী ওয়াশিংটনে একটি দালান ইত্যাদিতে আত্মঘাতীভাবে বিমান প্রবেশ করিয়ে সেই দালানগুলো ধ্বংস করে প্রায় চার হাজারের মতো লোক নিহত করলো। আমেরিকায় সেই সকাল নয়টার দিকে আমি কী করছিলাম তা আমার এখনো মনে আছে। আগ রাতে পারিকের সাথে সামান্য কথা কাটাকাটি হওয়াতে সেই সকালে কিছুটা মেজাজ নিয়েই অফিসে যাচ্ছিলাম। যাওয়ার আগেই হঠাৎ টিভিতে দেখলাম এক ভয়াবহ দৃশ্য। তারপর একটা মাস ছিল একটা ঘোরের আমেজে। বিশ্বাস হচ্ছিল না যে দুনিয়াটা কী রকম উলটা পালটা হয়ে গেলো। খবর আসতে লাগলো যে কিছু আরবরা এই কাজ সাধন করলো আর আফগানিস্তান থেকে ওসামা বিন লাদেন এটার দায় স্বীকার করে নিল। বাংলাদেশে আমারই এক ঘনিষ্ট আত্মীয় আমাকে ফোন করে আমার কুশলাদি জেনে নেয়ার সাথে সাথেই বলে উঠলোঃ “আমরা খুব খুশী হয়েছি”। বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মুসলমানদের কন্ঠে (অনলাইনে এবং টিভিতে) প্রথমে শোনা গেল তাদের পুলকিত হবার কথা, পরে শোনা গেল তাদের পেচানো নিন্দা করার কথা কিন্তু তার সাথে আমেরিকার এটা সেটা দোষের বৃত্তান্ত।
আমার দুইটা দুনিয়া – আমার পশ্চিমা মার্কিনি দুনিয়া আর বাংলাদেশি মুসলমান সত্বা – যেন একটা আরেকটার উপর হুমরি খেয়ে পড়লো। এই টক্করটা আমার মনের ভেতর এক ধ্বংসাত্বক বিস্ফোরণ তৈরি করলো। আমার ধর্মের মানুষরা এই কাজ করতে পারে? মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি যতই ঘোলাটে হোক, এই নিরীহ মানুষগুলোর কী দোষ ছিল? আগের রাতে মদ সেবন করে পরের দিন সকালে আল্লাহু আকবর বলে এই জানোয়ারগুলো এই ভাবে কোন ধর্মের নামে এই কাজটি সাধন করতে পারলো? আমি ভালোভাবেই জানি যে অনেক মুসলমানরা এখনো এটা বিশ্বাস করতে চায় না যে মুসলমানরা এই কাজ করতে পারে। তাই তারা গুজব ছড়িয়েছে যে ইহুদীরাই এই কাজ করেছে যাতে আমেরিকানরা পরে মুসলমান দেশ আক্রমণ করে। এই যুক্তিটা যতটাই না হাস্যকর, তার চেয়ে বেশি রাগ সৃষ্টিকারী।
দীর্ঘ নয় বছর পর সেই ডিসেম্বরেই আমি দেশে বেড়াতে আসি বাবা-মা ও বোনদের সাথে। তখন আমার নিকট আত্মীয় স্বজনদের টুইন টাওয়ার ধ্বংস হওয়ার আনন্দ উচ্ছাস দেখে ও আগের তুলনায় তাদের বাড়তি মুসলমানগিরি দেখে ঘৃণায় আমার চোখ বের হয়ে গিয়েছিল। ইসলাম ধর্মকে রক্ষা করার দায়িত্ব হঠাৎ করে এসে পড়লো আগে শাড়ি আর চুলের স্টাইল নিয়ে থাকা আমার অনেক মহিলা আত্মীয়দের উপর যারা এখন আরবদের ঝুলে থাকা কাপড় পরে আর মাথায় হিজাব টেনে নিজেদের বিশ্বাসকে বাঁচাতে শুরু করলো। তারপর আমেরিকায় আমার সেই ছোট শহরে ফিরে এসে আমি উপলব্ধি করলাম যে আমি বাংলাদেশি ঠিকই কিন্তু মুসলমান হতে পারি না। এই ধর্মের লোক যদি এমন জানোয়ারসুলভ হয়, তো সেই ধর্মেই আমার থাকার কোনো প্রয়োজন নেই। ধিক্কার দিলাম আমি এই ধর্মকে আর এই ধর্মের ধর্মালম্বীদেরকে।
আমার সমকামিতার জন্য আমার ধর্মের ভিত্তি দূর্বল হয়ে যাচ্ছিল অনেক আগে থেকেই। কিন্তু এই ঘটনার পর ভিত্তির যতটুকু বাকি ছিল তা নিঃশেষ হয়ে গেল। আমার আর দরকার ছিল না নিজেকে মুসলমান বলার আর এটার সাথে আমার কোনো পরিচয়কে স্বীকার করার। সময়ের সাথে সাথে জানতে পারলাম যে কোরআন ও হাদিসেই আছে বিভিন্ন আয়াত ও উক্তি যা আল-কায়দা থেকে শুরু করে বর্তমান যুগে মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামিক স্টেট (আই এস) পর্যন্ত ব্যবহার করে তাদের কর্মকান্ডের যৌক্তিকতা প্রকাশ করতে পারে। হ্যাঁ, আলেমরা বলেন যে সেগুলোর যথাযথ ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা রয়েছে। কিন্তু আমি বলবো যে যার যার ব্যাখ্যা তার তার কাছে। তাই বাংলাদেশে সবাই আরবিতেই কোরআন শরীফ উচ্চারণ করতে শিখে। বাংলা বা ইংরেজিতে কোরআন ও হাদিস পড়ে পাছে কিছু মানুষ না আবার নাস্তিক না হয়ে যায়, সেই ভয়ে সেটার দিকে আর কোনো জোর দেয়া হয় না। ভাগ্যক্রমে ফেসবুক আর ব্লগের যুগে বাংলাদেশে নাস্তিকতার লক্ষণ ক্রমশই বাড়ছে।
টুইন টাওয়ার ধ্বসে পরার পর মার্কিনিরা অনেক ধৈর্য আর সহিষ্ণুতার পরিচয় দেখিয়েছিল। সমগ্র দেশ জুড়ে মুসলমানদের উপর ঢালাওভাবে আক্রমণের কোনো খবর পাওয়া যায়নি এবং গণমাধ্যম সহ সবখানেই ছিল সহিষ্ণুতার ডাক। অধিকাংশ মার্কিনিরাই তাতে ভালোভাবে সারা দিয়েছিল। তবে দুই একটা খবর পাওয়া যায় যার মধ্যে একটা ছিল যেখানে মুসলমান ভেবে একজন শিখ মানুষকে কিছু বদমাশদের আক্রমণ করার ঘটনা। আমি ভেবে মরি যে বাংলাদেশে কিছু বিদেশি খ্রিস্টানরা ঢাকায় একটা দালান উড়িয়ে দিলে দেশের সবাই সব কয়টা দেশি খ্রিস্টানদের ধরে কি মেরে ফেলতো না? অথচ ৯/১১ ঘটনার পর বাংলাদেশি সমকামীদের ইয়াহু গ্রুপে চেনা কিছু আবালরা আমাকে জিজ্ঞেষ করার ধৃষ্টতা দেখিয়েছে যে আমেরিকায় মুসলমানদের এখন কী অবস্থা! আমেরিকানদের কী অবস্থা সেটা জানার তাদের কোনো ইচ্ছা ছিল না। যারা এরপর আফগানিস্তান এবং ইরাকে জর্জ বুশের আক্রমণের নিন্দা জানিয়েছে, তাদের নিন্দা গ্রহণযোগ্য। কিন্তু তাদের এটা ভুলে যাওয়া উচিৎ না কোন ঘটনাটা আগে ঘটে গিয়েছিল।
আমার ছয় বছরের সম্পর্কটা আমার পারিকের, সাথে আমারও কিছুটা মদের আসক্তিতে এতটাই অসহনীয় হয়ে উঠেছিল যে সম্পর্কটাকে আর টিকিয়ে রাখা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তার সাথে থেকে আমি হয়ে গিয়েছিলাম অসুখী। তার সবকিছু দেখতে দেখতে নিজেকেই হারিয়ে ফেলেছিলাম। ভুলে গিয়েছিলাম যে আমারও বিভিন্ন ইচ্ছা আছে, শখ আছে, আনন্দ আছে। আমার জীবনের সব চেয়ে কঠিন কাজ যেগুলো করতে হয়েছে তার মধ্যে আমার পারিকের সাথে ছয় বছরের যুগলের সম্পর্কটা শেষ করে দেয়াটা ছিল সেগুলোর মধ্যে অন্যতম। আর এই দিকে টুইন টাওয়ারের ঘটনার পর আমেরিকায় অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের উপর আসে মারাত্বক ক্ষতির হুমকি। আমি যেই অফিসে চাকরি করতাম তারা আমার মার্কিন স্থায়ী বাসিন্দার কাগজপত্র তৈরি করছিল ঠিকই কিন্তু এই প্রক্রিয়া যেহেতু অনেক দীর্ঘমেয়াদী, আমি সেই প্রক্রিয়ার চুরান্ত পর্যায়ে তখনও পৌছাতে পারিনি। আর সেই মুহুর্তে প্রতিষ্ঠানটি হয়ে যায় দেউলিয়া। এতে সেই দেশে আমার থাকা ও কাজের অনুমতি বাতিল হয়ে যায়। আমার জানা মতে অনেক বিদেশি পেশাজীবীদের এই সমস্যার সন্মুখিন হতে হয়। আমার এক বন্ধু নিউয়র্ক শহরে থাকতো এবং আমার কথা শুনে আমাকে আমন্ত্রণ করলো আমি যেন মিশিগান ছেড়ে দিয়ে তার এখানে চলে এসে আবার নতুন করে শুরু করার চেষ্টা করি।
আমার প্রাক্তন পারিক ও আমাদের গোছানো সংসার ছেড়ে দিয়ে নিউইউর্কে চলে আসার বেদনাটা ভোলার নয়। এ ছিল একটা পরাজয়ের মুহুর্ত। ছয় বছর এই সম্পর্কটাকে দিয়েছি নিজের সর্বস্ব শক্তি ও মন। সেটাকে বাঁচাতে পারলাম না, সেখানে থাকতেও পারলাম না। সে এখন আমার পারিক আর না থাকলেও, যেই মানুষটাকে এত দিন ভালোবেসেছি সেই মানুষটার প্রতি মায়া মহব্বত তো থেকেই যায়। তাকে আর আমার সেই ছোট্ট শহরকে সেই যে ফেলে এসেছি, আজ অবধি আর ফিরে যাইনি। নিউইউর্কে এসে দেখলাম যে সেই শহরে এত কিছু ধ্বংসের পর সেখানে সফটওয়ার প্রকৌশলীর কাজ একেবারেই নেই। অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গিয়েছে বা যেগুলো আছে সেখানে একটা চাকরির জন্য হাজারটা আবেদন। আর ৯/১১ ঘটনার পর মার্কিনি মানুষরা অনেক উদার মন দেখাতে পারলেও জর্জ বুশের প্রশাসন সেটা দেখাতে পারেনি। বুশ ঘোষণা দিল যে একটা সীমিত সময়ের মধ্যে ২৫টা মুসলমান প্রধান দেশগুলোর সকল বিদেশি নাগরিকদেরকে নির্ধারিত অফিসে হাজিরা দিয়ে তাদেরকে সেই দেশে থাকার কাগজপত্র দেখাতে হবে, আর তা না করলে ভবিষ্যতের জন্য তারা কালো তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে এবং পরে নতুনভাবে কোনো ভিসা থেকে বঞ্চিত হবে, গ্রেফতারকৃত হবে ও দেশ থেকে বহিষ্কার হয়ে যাবে।
আমি তখন পড়লাম দোটানায়। আমি হাজিরা দিলে আমার তখনকার বর্তমান অবস্থা তারা জেনে ফেলবে যে আমি মিশিগানে আমার চাকরি হারিয়ে তখন সেই দেশে থাকার অনুমতি হারিয়ে ফেলেছি। আর হাজিরা না দিলে ভবিষ্যতে আবারও চাকরি পেয়ে নতুন করে কাজের ভিসা বা স্থায়ী বাসিন্দার জন্য আবেদন করলে তারা দেখবে যে আমি আগে একটা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে হাজিরা দেইনি। তখন সাথে সাথেই গ্রেফতার করে বহিষ্কার। অন্ততঃ এই ভয়টাই প্রশাসন দেখিয়েছে এবং আশেপাশের অনেকেই একমত ছিল যে এখান থেকে আর বের হবার উপায় নেই (কোনো মেয়েকে ভুয়া ভিত্তিতে বিয়ে করে সেই দেশে থাকা ছাড়া, যা আমি কোনো দিনও করতে পারতাম না)। এই পরিস্থিতিতে আমাকে হার মেনে নিতে হলো যে আমার আমেরিকান স্বপ্ন হয়তো আর কোনো দিন বাস্তবায়ন হবে না। যেই দেশ আমাকে এত কিছু শেখালো, আত্মমর্যাদা দিল, নিজের মতো করে ভালোবাসতে দিল, উচ্চ লেখাপড়া শেখালো, চাকরি দিল, সেই দেশ ও দেশের মায়া ত্যাগ করে আজ আমাকে চলে যেতে হবে আরেক জায়গায়। এটা ছিল আরেক পরাজয় ও সবচেয়ে কঠিন কাজ যেগুলো করেছি তার আরেকটা।
আমি তার কিছু আগে থেকেই জেনেছি যে ততকালীন বিলেতি প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের আমলে যুক্তরাজ্যের কিছু নিয়মনীতি শিথিল করায় সেই দেশে অনেক পেশাজীবীদের নতুন করে ঢোকার প্রবেশপথ তৈরি হয়েছে বা হতে যাচ্ছে। এদিকে আমি আমার বাবা-মা ও বোনদের ফেলে অনেক দিন আমেরিকায় পড়ে আছি। তাদের কাছে বাকি জীবনের জন্য ফিরে যাওয়ার এটাও ছিল একটা ভালো অজুহাত। আমি নানান কৌশলে সীমিত সময়ের জন্য বিলেতি কাজের ভিসা পেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মায়া ত্যাগ করি এবং লন্ডনে নতুন জীবন শুরু করি। সময়ের সাথে সাথে সফটওয়ার প্রকৌশলী হিসেবে একটা চাকরিও পেয়ে যাই, যাদের মাধ্যমে এখন পেয়েছি এই দেশে স্থায়ী বাসিন্দার কাগজপত্র এবং তারপর নাগরিত্ব। আজ আমি বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের দ্বৈত নাগরিক।
এই ধকলগুলো সহ্য করেছি মনের শক্তি দিয়ে কিন্তু মদের আশ্রয় নিয়ে। লন্ডনের সমকামীদের সমস্ত বার ও ক্লাবে ছিল আমার অজস্র আসা যাওয়া এবং বেশ কিছু বছর আমি সেই মোহে নিজেকে হারিয়ে ফেলি। এখানকার সমকামী ইংরেজদের অমায়ীক ব্যবহার আমাকে আস্তে আস্তে এই দেশটার প্রতি আমার আগের ঘৃণা মুছে ফেলতে সাহায্য করে। আমি ইংরেজদের মাঝে দেখি আরেকটা রূপ যা আমাকে করে মুগ্ধ। আমি আমেরিকায় থাকার সময়ে এই দেশটার অনেক পরিবর্তন আসে। সেই পরিবর্তনটা সবচেয়ে বেশি লক্ষণীয় ছিল লন্ডনে। এখানে প্রকাশ্যে বর্ণবাদ আচরণ এখন আর একেবারে নেই বললেই চলে। সমাজেও এসেছে সমকামীদের প্রতি সহিষ্ণুতা ও শ্রদ্ধা।
সম্প্রতি একটা সময় এসেছিল যখন আমার এখানকার সবচেয়ে ঘনিষ্ট বন্ধুরাই ছিল অন্যান্য ইংরেজ সমকামী ছেলেরা। আমেরিকায় আমার সেই দীর্ঘ সম্পর্কটার পর আমার আর কোনো সম্পর্কে যাওয়ার ইচ্ছা হয়নি। বন্ধনহীন আনন্দেই দিনগুলো পার করেছি। কারো সাথে অন্তরঙ্গ মিলন যে হয়নি তা নয়। অবশ্যই হয়েছে। কারো প্রেমে যে পরিনি সেটাও আবার নয়। কিন্তু যাদের প্রেমে পড়েছি তারা সেই প্রেম পালটা নিবেদন করেনি আর যারা আমাকে চেয়েছে, তাদেরকে আমি চাইনি। এই হচ্ছে সমকামীদের এক বিরাট বাস্তবতা। বয়সের সাথে সাথে এর প্রভাব আরো বেশি করে লক্ষ্য করলাম। বিরাট এই শহরে ইংরেজ ছাড়াও বহু দেশের বহু সমকামী ছেলে এখানে বন্ধনহীন আনন্দে লিপ্ত। কেউ কেউ সম্পর্কে যায়, তাও আবার খনিক কিছু দিন বা মাসের জন্য। কখন কোথায় আবার নতুন কারো দেখা মেলে, সবাই থাকে সেই ধান্দায়।
কিছু সময় পর দেখলাম বাংলাদেশ থেকে আগত হয়েছে কিছু নতুন সমকামী ছেলেরা যাদের সাথে বন্ধুত্ব আমাকে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করে দেয়। মনে আছে যে আমি এক সময়ে ভেবেছিলাম যে আমি বুঝি একমাত্র বাংলাদেশি সমকামী? সেই ভুল ভাঙলো আরো সুন্দরভাবে এবং একজন বাংলাদেশি সমকামী হিসেবে আমি আরো গর্ব অনুভব করলাম। এদিকে লন্ডনে আসার পর থেকেই আমি প্রায় প্রতিটা বছর এখানকার বাৎসরিক সমকামীদের পদযাত্রা বা “প্রাইড”-এ অংশ করি কখনো বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে, কখনো সেচ্ছাসেবকদের একজন হয়ে। এতে আমার মাঝে গড়ে ওঠে নিজের দেশের সমকামীদের প্রতি আমার একটা গভীর দায়িত্ববোধ। এই দেশ ও পশ্চিমা অনেক দেশগুলোতে দেখলাম সমকামীদের বিরুদ্ধ সকল আইন প্রত্যাহার ও তাদের বিবাহের অনুমোদন। যুগান্তকারী এই পদক্ষেপগুলো এই সব দেশে বাস করা সকল যৌন সংখ্যালঘুদের জন্য ছিল আশাতীত। কিন্তু বাংলাদেশের যৌন সংখ্যালঘুরা আজ কেমন আছে? তারা কি এই সব স্বপ্ন ভুলেও কখনো দেখতে পারে?
বিলেতের প্রতি আমার নতুন শ্রদ্ধা আর ভক্তি ভেঙ্গে গেল দুই বছর আগের মাঝামাঝি এই দেশ ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছেড়ে দিবে কি না সেই গণভোটের ফলাফলের কারণে। ৫১% মানুষ ই-ইউ ছেড়ে দেবার পক্ষে ভোট দেয় আর ৪৯% থাকার পক্ষে। এরকম একটা গণভোট এই দেশের বিভক্ত মানসিকতাকে ফুটিয়ে তোলে যা ছিল বেশ পীরাদায়ক। ৪৯% মানুষ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর গঠিত এই গোত্রের কারণে পশ্চিমা ইউরোপে যেই শান্তি, ভাতৃত্ববোধ আর সমৃদ্ধি এসেছে তার মূল্যায়ন করার ক্ষমতা রাখে কিন্তু বাকি ৫১% মানুষরা তথাকথিত ইংরজি নাক উঁচু মনোভাব, বর্ণবাদিতা আর বিদেশাতঙ্কে ছিল জর্জরিত। গণভোটের আগে নির্বাচনী প্রচারণায় এই দেশে ই-ইউ থেকে আগত অনেক বিদেশি শ্রমিক ও পেশাজীবীদের বিরুদ্ধে প্রচার করা হয় কুৎসা আর ভীতি। এই প্রচারণার ফলে ই-ইউর বাইরের কিছু মানুষ যেমন দক্ষিণ এশিয়া, ওয়েষ্ট ইন্ডিজ ও আফ্রিকা বংশভুত বিলেতিদের উপরেও বর্ণবাদী আচরণ কিছু সময়ের জন্য বেড়ে যায়। ২০১৬ সালে দেখলাম ১৯৮০ দশকের পদধ্বনি। আমি আবারও এই দেশের প্রতি কিছুটা ঘৃণা অনুভব করলাম যদিও এই দেশের আইনের শাসন, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ এবং এতদিন পাওয়া বিভিন্ন সুযোগ সুবিধার প্রতি আমার তখনও রয়েছে অঢেল শ্রদ্ধা এবং কৃতজ্ঞতা। সেটা মনে করেই মেনে নিলাম এই দেশের পরিণতি। ই-ইউ ছেড়ে দেয়ার পর এই দেশ হবে অপেক্ষাকৃত দরিদ্র। ইউরোপের অধিকাংশ দেশের সাথে রয়েছে বিলেতের সংযুক্ত বানিজ্যিক সম্পর্ক। সব ভেস্তে যাবে এবং মানুষদের জীবন যাত্রার মান কমে যাবে। তবুই সেই ৫১% মানুষ ই-ইউ থেকে “স্বাধীন” হতে চায়। তারা নিজেরা দুনিয়া শাসন করেছে, তাই তারা ই-ইউর নিয়ম কানুন মানতে রাজি নয়।
এই দেশকে আমি ভালোবাসতে পারিনি, কিন্তু শ্রদ্ধা করতে শিখেছি। কিন্তু সেই শ্রদ্ধা এই দেশের সেই শ্রমিক শ্রেণির মানুষদের উপর আসেনি যারা ঢালাওভাবে ভোট দিয়ে এই দেশটাকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের করে দেয়ার চেষ্টা করলো। আর তাদের প্রতি আমার ছোট বেলায় তৈরি হওয়া মনোভাব এই ভোটের কারণে আরো দৃঢ় হলো। মজার ব্যাপার হচ্ছে যে আমি ভেবেছিলাম যে এই দেশের জাতিগত সংখ্যালঘুরা হয়তো ই-ইউতে থাকার পক্ষেই ভোট দেবে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তা হয়নি। এই দেশে বাংলাদেশের সিলেট থেকে আগত অনেক বিলেতি বা বিলেতি হবেন এমন মানুষরা উপমহাদেশীয় খাবারের রেস্তোরাঁর ব্যবসায় নিয়জিত। এই ব্যবসাগুলো এতই সফল যে ভারতীয় বা বাংলাদেশি খাবারের এক অদ্ভুত নতুন সংস্করণ এখন এই দেশে বিলেতিদের সবচেয়ে পছন্দনীয় খাবার বলে গণ্য করা হয়।
ই-ইউ থেকে এত শ্রমিক চলে আসার একটা পরিণাম ছিল যে বাংলাদেশ থেকে বাবুর্চি আসার পথ অনেকখানি কমে গিয়েছিল আর ই-ইউ ছাড়তে চায় এমন রাজনীতিবীদরা সেই রেস্তোরাঁর মালিকদেরকে আশ্বাস দিয়েছিল যে ই-ইউ থেকে সকল শ্রমিক আসা বন্ধ হলে বাংলাদেশ থেকে বাবুর্চি আনার পথ তারা সুগম করে দেবেন। আমি এটা শুনেই বুঝেছিলাম যে এটা হচ্ছে ই-ইউ ছাড়ার সকল মিথ্যা প্রচারণাগুলোরই একটি এবং পরে দেখা গেছে আসলেই ব্যাপারটা ছিল ঠিক তাই। আহাম্মক রেস্তোরাঁর মালিকরা দল বল মিলিয়ে ই-ইউ ছাড়ার পক্ষে ভোট দিয়েছে অথচ ব্রেকজিট (ই-ইউ ছাড়ার প্রক্রিয়াটি) সম্পন্ন করতে বদ্ধপরিকর বর্তমান সরকার বাংলাদেশ থেকে নতুন করে বাবুর্চি আনার কোনো পরিকল্পনা রাখেনি। গাধাসুলব মানসিকতা শুধু ইংরেজ শ্রমিক শ্রেণির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না।
ফিরে আসি সমকামীদের কথায়। বলে রাখা উচিৎ যে এই সব দেশেও দীর্ঘদিন ধরে সমকামীরা সামাজিক ও আইনই বৈষম্যের শিকার হওয়ার ফলে কিছুটা বিদ্রোহী মনোভাব নিয়ে তাদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশের মধ্যে প্রবেশ করেছে বিভিন্ন মাদক সেববের প্রবণতা। “ক্রিস্টাল মেথ” যা বাংলাদেশে ইয়াবার সমতূল্য, তা সর্বনাশ করে ফেলেছে বিভিন্ন সমকামীদের জীবন। এই মাদক ও অন্যান্য মাদক মিশিয়ে অনেক ছেলেরাই যৌন কর্মে লিপ্ত হয় দিনের পর দিন বিভিন্ন ঝুঁকি নিয়ে, জীবনের বাদ বাকি সব কিছু ভুলে গিয়ে। এর পরিণাম হচ্ছে মর্মান্তিক। বাংলাদেশে ইয়াবাখোরদের মতো এরাও এদের স্বপ্ন ভাংচুর করছে, স্বাস্থের ক্ষতি করছে, ও বিভিন্ন রোগ বালাইয়ের শিকার হচ্ছে। এই আই ভি এইডসের এখন টিকা জাতীয় প্রতিরোধক অশুধ আছে বলে কন্ডমহীণ যৌনাচার আবার ৭০ দশকের মতো মাথা চারা দিয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের সমকামী ছেলেদের হুশিয়ার করে দিতে চাই যে অবাধ যৌনাচারের সাথে যেন ইয়াবা বা অন্যান্য মাদক এমন কি অধিক পর্যায় মদ জাতীয় জিনিষ মিশ্রিত না হয়। এতে নিজের বুদ্ধি ও বিবেকের লোপ পায় এবং ফলাফল হয় শোচনীয়। এসব মাদক থেকে আমি নিজেকে মুক্ত রাখতে পারলেও মদ আমার জীবন প্রায় শেষ করে দিয়েছিল লন্ডনে এসে। কিন্তু আগেই বলেছি যে আজ আমি সম্পূর্ণ মদ মুক্ত।
আবার ফিরে যাই বাংলাদেশে। আওয়ামী লীগের শাসনামলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন হওয়াতে সেই সরকারের উপর আমার জন্মেছিল অঢেল শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা। তবে বিচার শুরু হওয়ার পর লন্ডনে বসে দেখলাম যে বাংলাদেশের জামাতে ইসলামি দলটা এই দেশে তারই সহধর্মী মুসলিম কাউন্সিল অফ বৃটেনকে ব্যবহার করে এই সব দেশের মুসলমানদেরকে চরমভাবে উসকে দিতে শুরু করলো। যারা বাংলাদেশি বা পাকিস্তানি পিতা-মাতার বিলেতি সন্তান এবং পিতা-মাতার ভাষা বা সংষ্কৃতির সাথে ভালোভাবে পরিচিত না হলেও ধর্মটা ঠিকই ধরে রেখেছে বিলেতি মুসলমান হিসেবে, তারা টুইটার ও অন্যান্য যোগাযোগ মাধ্যমে ঢালাও ভাবে “বাংলাদেশ বাঁচাও” বলে প্রচারণা শুরু করতে লাগলো। কোন জিনিষটা থেকে বাংলাদেশকে বাঁচাতে হবে জানতে হলে ইউটিউবে আজমল মনসুরের কিছু শুক্রবারের ওয়াজ শোনা যেতে পারে। তিনি লন্ডনের একটা মসজিদে তখন ইমামতি করতেন এবং তিনি বাংলাদেশি বংশভুত একজন বিলেতি নাগরিক। সেই মসজিদে তিনি “শেখ হাসিনা বাংলাদেশে ইসলামকে ধ্বংস করে দিচ্ছে” ইত্যাদি মিথ্যা কথা বলে যা প্রচার করছিলেন সেটা এই দেশের ফাঁকা মস্তিষ্কের ছাগলের বাচ্চারা গিলেছে এবং তাদেরকে খুব ভালোভাবেই বুঝিয়ে দেয়া হয়েছিল যে যুদ্ধাপরাধীরা আসলে ছিলেন নানান ধর্মীয় গুরু এবং এদেরকে নানান ভুয়া অজুহাতে দন্ডিত করে হাসিনা বাংলাদেশ থেকে ইসলাম উঠিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। আমি শুনেছি যে আমেরিকাতেও না কি একই চিত্র দেখা গেছে।
এই মিথ্যা প্রচারণা মুখ বুঝে সহ্য করার ক্ষমতা আমার এবং এই দেশে বাস করা অনেক বাংলাদেশির পক্ষেই সম্ভব ছিল না। তাদের মতো আমিও টুইটারে ইংরেজিতে দিন রাত মিথ্যা প্রচারণার জবাব দিয়েছি এবং গাধাদের মাথায় সত্য কিছু তথ্য উত্থাপন করার চেষ্টা করেছি। শাহবাগ আন্দোলনের সাথে একাত্বতা ঘোষণা করে এখানে বসে তাদের প্রচারণা ইংরেজিতে করে দেয়ার চেষ্টা করেছি। বিদেশি সংবাদমাধ্যমগুলো শাহবাগের এই জাগরণের মাথা মুন্ডু কিছুই বুঝতে পারেনি আর তাই বাংলাদেশে নতুন করে ফিরে আসা এই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং যুদ্ধাপরাধের সঠিক ইতিহাস তেমনভাবে তুলে ধরতে পারেনি। তাই আমরা অনেকেই ব্লগ লিখে লিখে সঠিক তথ্য বহির্বিশ্বের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। বিদেশে বসেই আমরা দেশের প্রতিটা মুহুর্তের সাথে এক হয়ে ছিলাম আর একেকটা রায় কার্যকর হওয়ার সময়ে শ্বাসরূদ্ধ হয়ে বসেছিলাম। একেকটা রায় কার্যকার হওয়ার সময়ে নানান জায়গার লোকদের সাথে তর্ক করতে হয়েছে টুইটারে। এক হচ্ছে কিছু পাকিস্তানিদের সাথে যারা তাদের আগের বংশের সেনাদের হাতে বাংলাদেশের হৃদয়বিদারক মুক্তিযুদ্ধ এবং লাখ লাখ শহীদ এবং ধর্ষিতা মা-বোনদের কথা কিছুই জানে না। দুই হচ্ছে সব পশ্চিমা আঁতেলদের সাথে যারা সকল ক্ষেত্রেই মৃত্যুদন্ডের বিরুদ্ধে। তারা মৃত্যুদন্ডের এতটাই বিরুদ্ধে ছিল যে সেটাকে কেন্দ্র করে এরাও জামাতের সুরে পুরা বিচার প্রক্রিয়াটাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে, এটা সেটা বলে আখ্যায়িত করেছে।
এই নিয়ে আমার বক্তব্য হচ্ছে যে বাংলাদেশ থেকেও মৃত্যুদন্ড উঠিয়ে দেয়া উচিৎ কিন্তু তা এই জঘন্য যুদ্ধাপরাধী রাজাকারদের দিয়ে শুরু করা যেত না। কোনো দিনও না। বাংলার মাটিতে এদের যাবত জীবন কারাদন্ড হলে বিরোধী দল বিএনপি তাদের দোষর জামাতের সাথে আবার ক্ষমতায় এলে সব কয়টা অপরাধীরা ছাড়া পেয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আর ধর্ম নিরপেক্ষতার সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াত। ১৯৭১ সালে গোলাম আজমরা যা করেছিল তা সুযোগ পেলে তারা আবারও করতো সেই ব্যাপারে সন্দেহ রাখার কোনো অবকাশ ছিল না। তাছাড়া আমি চিরকালই যুদ্ধাপরাধ এবং জঙ্গি সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের জন্য মৃত্যুদন্ডের পক্ষে থাকবো।
এখানে সবচেয়ে বেশি লক্ষণীয় ব্যাপারটা হচ্ছে যে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের সাথে সাথেই এই হারামীরা দেশ থেকে চিরকালের জন্য পালিয়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশ ছিল এই জানোয়ারদের পদধূলা বিহীন। এরা কীভাবে আবার স্বাধীন দেশে ফিরে আসার ধৃষ্টতা দেখাতে পারলো? সেটা নবপ্রজন্মকে ভালোভাবে জানতে হবে। জিয়াউর রহমান তার নিজের হাত শক্তিশালী করতে এই নরকের কীটগুলোকে আস্তে আস্তে দেশে ফিরে আসার সুযোগ করে দেয়। এরা ফিরে আসলে এরা ইসলামি মূল্যবোধের গান গাইতে পারবে যেটা তারা ৭১ সালেও গেয়েছিল এবং সেটার দোহাই দিয়ে পাকিস্তান ভাঙ্গার বিপক্ষে থেকে পাক সেনাদেরকেই সাহায্য করেছিল বাঙ্গালীদের বিরুদ্ধে গনহত্যা আর ধর্ষণ চালিয়ে যাবার জন্য। ইসলামি মূল্যবোধের গান গাইলে এবং তাতে জিয়ার হাত থাকলে তার শ্বাসনামলে ভেতো বাঙ্গালী মুসলমানদের সহানুভুতি বাড়বে এবং হয়েছিলও ঠিক তাই। কিন্তু এই কাজ করে জেনারেল জিয়া যে বাংলাদেশের রাজনীতিকে চিরতরে ধ্বংস করে দিয়ে গেছে সেটা বিএনপি সমর্থকদের বোঝানোই যায় না, যদিও জেনারেলটার এই খেলা ক্ষমার অযোগ্য।
আওয়ামী লীগই ছিল স্বাধীনতা এবং ধর্মনিরপেক্ষতার সত্য আহবায়ক। কিন্তু আমার সেই ধারণাটা ক্রমেই বদলাতে শুরু করে যখন সম্প্রতিকালে হেফাজতের পাছা চুম্বন করতে গিয়ে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা উঠে যায়। আর তার সাথে দেখতে পাই ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত বিরোধী মনোভাব ও আইন যেগুলো একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। বাংলাদেশের সংবিধান সংষ্কারের সময়ে তিনি ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনলেও ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঠিকই রেখে দিয়েছেন এবং সংবিধানের শুরুতে বিসমিল্লাহটা এখনো রয়ে গেছে। সংবিধানটা যেন মুসলমানদেরই একটা কাগজ। এবং রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হওয়াতে দেশের বাকি ধর্মালম্বী এবং নাস্তিকরা এখনো দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। লীগের ভক্তরা বলে থাকেন এটা ভোটের রাজনীতি। বেশ, তো এই ভোটের রাজনীতি করতে গিয়ে যারা নিজেদের নীতি বিসর্জন দিতে পারে, তারা আমার মতো মানুষের ভোট পাবে কেন? আমরা যারা মুক্ত চিন্তাবীদ, ধর্মনিরপেক্ষ, নাস্তিক ও যৌন সংখ্যালঘু, তারাও সবাই মিলে ছিলাম একটা ভোট ব্যাংক। কিন্তু এই সরকার আমাদেরকে বানিয়েছেন বলির পাঠা।
তা না হলে কী করে দেশে ইসলামি জঙ্গিদের হাতে একের পর এক মুক্তমনা আর নাস্তিক খুন হলো অথচ প্রধানমন্ত্রী প্রথমে বিরোধী দলের উপর সেটার দোষ চাপিয়ে দিয়ে পরে ব্লগারদেরকেই দোষী করেছেন ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে লেখার জন্য? এতে কি জঙ্গিরা তাদের হায়না স্বরূপ আক্রমণ করার বাড়তি উৎসাহ পায় নি? ঢাকার গুলশানে একটা ক্যাফেতে অনেক বিদেশি খুন হওয়ার পরে সরকারের টনক নড়েছে অথচ তার বহু আগে জঙ্গিদের পেছনে সরকার লেগে পড়লে আজ বেঁচে থাকতো অভিজিৎ রায়, জুলহাজ মান্নান সহ আরো অনেকে। কিন্তু তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকে যা শোনা গেছে তা আমাদেরকে করেছে হতাশ। ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসের শেষ নাগাদ ইসলামি জঙ্গিদের হাতে যখন বাংলাদেশের সমকামী অধিকার কর্মী জুলহাজ মান্নান এবং সমকামী সাংষ্কৃতিক কর্মী মাহবুব তনয় নির্মমভাবে খুন হলো, তখন বাংলাদেশের সুশীল সমাজ থেকে শুরু করে সরকারের নিরব ভুমিকা ক্ষমার অযোগ্য।
বাংলাদেশের আবালদের কাছে থেকে প্রায়ই শোনা যায় যে ৯২% মুসলমান দেশে মুসলমানরা যা চাবে তার মানেই না কি গণতন্ত্র। অথচ সেটা ভোটের ক্ষেত্রে হলেও দেশ শাসনের সময়ে সংখ্যাগরিষ্ঠদের ইচ্ছা পূরণ করার সময়ে এটাও সমানভাবে খেয়াল রাখতে হয় যে কোনোভাবেই সংখ্যালঘুদের স্বার্থ যেন বিঘ্নিত না হয়। এই পরষ্পর বিরোধী দুই নীতির সংমিশ্রণেই প্রকৃত গণতন্ত্রের চেহারা ফুটে উঠে। একই আবালদের মনেও থাকে না যে ১৯৭২ সনে বাংলাদেশের সংবিধান প্রতিষ্ঠার সময়ে সেখানে কোনো রাষ্ট্রধর্ম ছিল না। দেশে কি তখন কোনো মুসলমান ছিল না? আশির দশকে শৈরাচারী এরশাদ তার অবৈধ ক্ষমতাকে আরো কুক্ষিগত করার জন্য মুসলমানদের সহানুভূতি পাওয়ার আশায় সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম এনে দেশের সংবিধান ও সমাজকে কলূষিত করে ফেলেন। এই প্রক্রিয়া শুরু হয় তার আগে জেনারেল জিয়া রহমানের আমল থেকেই। এই ইতিহাস এখন ভুলে গেলে চলবে না।
সমকামীদের দুই নক্ষত্র জুলহাজ ও তনয় আমাদের কাছ থেকে চলে যাবার পর বাংলাদেশে যৌন সংখ্যালঘুদের করুন দশা কিছুটা লাঘব হয়ে আজ এক নতুন দিগন্তের সূচনা হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশের প্রতিটা গ্রামে, প্রতিটা ছোট ও বড় শহরে মোবাইল ফেসবুক ও মেসেঞ্জারের মাধ্যমে অল্প বয়সী সমকামী ছেলে ও মেয়েরা সাহস নিয়ে আত্মপ্রকাশ করছে, একজন আরেকজনের সাথে পরিচিত হচ্ছে, নিজের সুখ ও দুঃখের কথা বলছে, প্রেমে পড়ছে বা নিছক যৌন মিলনের জন্য দেখা সাক্ষাৎ করছে। আর এদেরই অনেকে আমাকে খুঁজে বের করেছে মনে সাহস পাবার জন্য, নিজেদের কথা বলার জন্য। আমিও তাদের সুখ ও ভবিষ্যতের জন্য উৎসর্গ করে দিয়েছি আমার বাকিটা জীবন। এরা অনেকেই এখন আমার একটা নিজের পরিবারের মতো। এদের আনন্দে আমি হাসি, এদের দুঃখে আমি কাঁদি। বিলেতিদের রেখে যাওয়া বাংলাদেশের দন্ডবিধির ৩৭৭ ধারা যা প্রকৃতি বিরুদ্ধ যৌনাচার হিসেবে সমলৈঙ্গিক সম্পর্কগুলোকে অবৈধ হিসেবে দেখে এবং দেশের সকল যৌন সংখ্যালঘুদের সমান, মানবিক, আইনি ও সামাজিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে, তার বিরুদ্ধে সবার মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে এবং অন্যান্য অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও তার বিলুপ্তি ঘোষণা করতে হবে। বাংলাদেশের আইন ইসলামের শরীয়া দ্বারা গঠিত নয় এবং কোনো দিন সেটা হতেও দেয়া যাবে না। তাই ইসলাম ও অন্যান্য ধর্ম সমকামিতা নিয়ে কী বলে তা নিয়ে রাষ্ট্রের মাথা ঘামাতে হবে না। রাষ্ট্র এখানে সকল নাগরিকের সমান অধিকার ও প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর।
আর সবচেয়ে বেশি এখন যেটার প্রয়োজন তা হচ্ছে দেশের যৌন সংখ্যালঘুদের মাঝে ঐক্য। বর্তমানে এটারই বড় অভাব। এক দল দেশে সকল প্রকার অধিকার নিয়ে মগ্ন, আরেক দল নিরালায় সারা জীবন বিভিন্ন যৌন কর্মে লিপ্ত হয়েই শান্ত – এরা ভবিষ্যতে বিপরীত লিঙ্গের কাওকে বিয়ে করে বসে থাকবে পরিবার ও সমাজকে মুখ দেখানোর জন্য। আরেক দল আছে যারা গেমিন অর্থাৎ গে + মুমিন। এরা রাতে সমকামিতাও করবে এবং দিনের বেলায় ধর্মের সাফাই গেয়ে সমকামিতার নিন্দা করবে। এরা যৌন সংখ্যালঘুদের সব চেয়ে বড় শত্রু। আর তার উপর আছে অনেক উভকামী ছেলে যারা সমকামীদের সাথে লিপ্ত থেকে, পরে তাদের মন ভেঙ্গে দিয়ে একটা মেয়ে বিয়ে করে বসে থাকে যা তারা তাদের যৌন প্রবৃত্তির কারণে সহজেই করতে পারে। এই সকল ব্যাপার নিয়ে মুক্ত আলোচনার প্রয়োজন। আমি কোনো সমকামীকে নাস্তিক হয়ে যেতে বলবো না। কিন্তু ধার্মিক চিন্তাভাবনা যে সমকামীদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার সবচেয়ে বড় অন্তরায়, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
২০০০ দশকের দিকে বাংলাদেশে সমকামী অধিকার নিয়ে সোচ্চার হয়ে উঠে ঢাকার অভিজাত এলাকার ইংরেজিভাষী ফটফটিরা। তাদের অবদান ভুলবার নয়। তাদের “বয়েজ ওফ বাংলাদেশ” নামের দলটার মাধ্যমে সুশীল সমাজে কিঞ্চিৎ আলোড়ন সৃষ্টি হয় বাংলাদেশে আমাদের অস্থিত্ব নিয়ে। তারপর জুলহাজ মান্নানের বলিষ্ঠ ভুমিকায় আসে “রূপবান” যেখানে বাংলাদেশের বাকি অংশ থেকে মূলত বাংলাভাষীদের ক্ষমতায়নের চেষ্টা করা হয়। এখন সময় এসেছে দেশের একেবারেই আনাচে কানাচে চলে যাবার। সেখানকার সকল প্রান্তিক যৌন সংখ্যালঘুদের কাছে আগে ভাগেই এই বার্তা পৌছে দিতে হবে যে সমকামী, উভকামী, রূপান্তরকামী, অদ্বৈত, আন্তঃলিঙ্গ, লিঙ্গতরল ইত্যাদি হিসেবে তাদেরও আছে অধিকার এবং তাদের যৌন প্রবৃত্তি বিষমকামীদের যৌন প্রবৃত্তির মতোই স্বাভাবিক। তাদের লিঙ্গ পরিচয় নারী ও পুরুষদের মতোই স্বাভাবিক। যৌন প্রবৃত্তিটা জন্মগত অথবা জন্মের ঠিক পরেই নির্ধারিত এবং ডাক্তারই বিজ্ঞান দ্বারা প্রমাণিত। তাদের জীবনের সুখ আসবে আত্মগ্রহণের মাধ্যমে, তারপর পরিবার, বন্ধু-বান্ধব, সমাজ ও রাষ্ট্রের গ্রহণের মাধ্যমে। আমরা প্রথম থেকেই এই তরুণ ও তরুণীদেরকে ভরসা ও ইতিবাচক চিন্তাভাবনা দিয়ে ভরে দিয়ে মাঠ পর্যায় থেকে একটা চেতনা ও শক্তি গড়ে তুলবো। বাংলাদেশে যৌন সংখ্যালঘুদের অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে আমাদের দ্বিতীয় স্বাধীনতা – পরাধীনতা ও ধর্মীয় বেড়াজাল থেকে বের হয়ে এসে এক নতুন দিনের সূচনায় এক নব প্রভাতের উন্মোচনা।
