অনাকাঙ্খিত কারণবশত বাংলাদেশের এবং সমগ্র বাংলাভাষী যৌন সংখ্যালঘু এবং তাদের শুভানুধ্যায়ীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত বৈচিত্র্য নামের তথ্য ও সৃজনশীলতা ভিত্তিক জালপাতা আমার একার পক্ষে আর রক্ষণাবেক্ষণ ও চালানো সম্ভব নয় বলে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আমি এই পাতাটি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছি। কিন্তু সেটার স্মৃতি মুছে যাওয়ার নয়। অনেক মানুষের স্বপ্ন ও আকাঙ্খা সেখানে পরিস্ফুটিত হয়েছিল। পাতাটির সূচনা হিসেবে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে লেখা “আমাদের সম্বন্ধে” প্রচ্ছদটি এখানে হুবুহু উঠিয়ে দিলাম।

রিয়াজ ওসমানী

২ ফেব্রুয়ারী ২০২১

আমরা সমকামী এবং উভকামী (মহিলা বা পুরুষ)। আমরা রূপান্তরকামী, রূপান্তরলিঙ্গ, আন্তঃলিঙ্গ, অদৈত্ব, লিঙ্গতরল এবং রূপান্তররূপী। আমাদের সমষ্টিকে কিছু ইংরেজি অক্ষর দিয়ে সংক্ষেপে “এলজিবিটি” বা “এলজিবিটিকিউআইএ” বলা হয়। বাংলা ভাষার প্রেক্ষাপটে আমরা “যৌন সংখ্যালঘু”। পৃথিবীর ৫ থেকে ১০ শতাংশ মানুষ এই গোত্রে পড়ে এবং বাংলাদেশেও এর কোন ব্যতিক্রম নেই। আমরা বাংলাদেশি এবং বাংলাভাষী যৌন সংখ্যালঘু। এই আন্তর্স্থানটিতে অনেক জায়গাতেই যৌন সংখ্যালঘু অথবা সমকামী বলে একই জিনিষ বোঝানো হয়েছে, যদিও স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই যে এই ক্ষেত্রে সমকামী কথাটা যৌন সংখ্যালঘুর পুরা পরিবারটিকেই বোঝাচ্ছে, শুধু সমকামীদেরকে নয়। একটু আগে উল্লেখিত সবাইকে নিয়েই আমাদের বৈচিত্র্য। আর আমরা এসেছি সমাজের সকল স্থর থেকে। কারও পিতা-মাতা বিত্তবান এবং আমরা পশ্চিমা হালচাল নিয়ে চলি। কেউ এসেছি দরিদ্র ঘর থেকে এবং জীবনের কোন কূলকিনারা খুঁজে পাই না। আবার আমরা কেউ মধ্যবিত্ত যারা অর্থনৈতিক, ধার্মিক, সাংষ্কৃতিক এবং সামাজিক ভারসাম্য রাখতে গিয়ে হিমসিম খেয়ে ফেলি। আমরা থাকি দেশের ছোট ছোট গ্রামে আবার বড় বড় শহরে। মফস্বলের বিভিন্ন আঞ্চলিকতা আমাদেরকে মাঝে মাঝে বিভক্ত করে। তার উপর আছে ধর্ম অনুসরনের কারনে আমাদের মাঝে আরেক বিভক্তি। এই বিভক্তি এড়াতে বা ধর্মীয় অনুশাসন অনুযায়ী আমাদের জীবনের প্রতি প্রতিকূল মনোভাব সৃষ্টি হওয়াতে নিজেদের ভেতর দ্বন্দ্ব কাটিয়ে উঠতে আমরা কেউ কেউ হয়েছি নাস্তিক। আর তা না হলে আমাদের ধর্ম বিশ্বাস আর আমাদের যৌনতাকে নিয়ে আপন মনে একটা সমঝোতায় আসার চেষ্টা করেছি। বাংলাদেশের আদিবাসীদের মধ্য থেকেও সমকামীরা ফেসবুক যুগে সোচ্চার। এখানে আমরা সবাই মিলে একটা বড় পরিবার।

এখানে আমাদের সাথে আরও থাকছেন ভারতের পশ্চিম বাংলা ও অন্যান্য অঙ্গরাজ্যের সমকামী বাঙ্গালী – পৃথিবীর সবখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সকল বাংলাভাষী যৌন সংখ্যালঘুরা। আমরা এখানে আমাদের কথা বলব, আমাদের যৌন প্রবৃত্তির বিষয়টি উন্মোচন করবো এবং এই নিয়ে বাংলাদেশ এবং বিভিন্ন জায়গায় বাঙ্গালী সমাজের সকল ভুল ও বদ্ধ ধারনা শুধরে দেবার চেষ্টা করবো। আমরা সমকামিতা ও যৌন প্রবৃত্তি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক এবং অধ্যাপক সুলভ তথ্য ইংরেজি ভাষা থেকে বাংলায় অনুবাদ করবো – সমাজ, সংষ্কৃতি ও ধর্ম আমাদের নিজেদের জীবনে যে প্রভাব ফেলেছে তা নিয়ে আলাপ করবো। আমরা তুলে ধরবো ভারত উপমহাদেশে বিলেতিদের রেখে যাওয়া দন্ডবিধির ৩৭৭ ধারাকে, যেটাকে ধার্মিক ও সাংষ্কৃতিক দিক থেকে ব্যবহার করে এই অঞ্চলের বর্তমান স্বাধীন দেশগুলোতে রেখে দেয়া হয়েছে। ভারতে তা উঠিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা অবশেষে সফল হলেও বাংলাদেশে এটা নিয়ে কোন উদ্যোগ এখনও শুরুই হয়নি। এই আইন আমাদের জন্য কত খানি ক্ষতিকর এবং বাংলাদেশে এটা উঠিয়ে দেয়ার প্রক্রিয়া কতখানি চলমান, সেই ব্যাপারগুলো নিয়ে আমরা এখানে সবাইকে হালনাগাদ করে রাখবো।

এখানে আমাদের সৃজনশীলতা ফুটে উঠবে। আমরা ভালো গল্প লিখতে পারি, কবিতা লিখতে পারি, ছবি অঙ্কন করতে পারি, ভালো অডিও বা ভিডিও বানাতে পারি। আমরা তথ্যপ্রযুক্তিতে এগিয়ে – আমরা আর পাঁচ-দশজনের মত সমাজ ও দেশের সম্পদ। আমরা ভালো ছাত্র-ছাত্রী, আমরা ভালো চাকরিজীবি, ভালো কৃষক, ভালো দিনমজুর, ভালো শ্রমিক এবং ভালো ব্যবসাই। আমরা ভালো ডাক্তার, ভালো আইনজীবি, ভালো প্রকৌশলী, ভালো দার্শনিক এবং রাজনীতিবীদ। আমরা ভালো গায়ক, বাদ্য বাদক, পরিচালক, সুরকার, অভিনেতা এবং নৃত্যকার। আমরা ভালো বিজ্ঞানী, ভালো সৈন্য বা সেনাপতি। আমাদের যৌন প্রবৃত্তি ডাক্তারই বিজ্ঞান দ্বারা প্রমানিত – আমাদের ভালোবাসাগুলো যে কোন কবি-সাহিত্যিকদের বর্ণিত লেখনীতে ফুঁটে ওঠার যোগ্য স্থান পায়। আমাদের জীবন আর বাকি সবার জীবনগুলোর মতই মূল্যবান। আমাদেরও সত্ত্বা আছে, অনুভুতি আছে, আছে যৌন কাম – হোক সেটা সংখ্যাগরিষ্ঠদের থেকে কিছুটা ভিন্ন। এই সমাজ ছোট বেলা থেকেই আমাদেরকে বিষমকামীদের মত শুধু বিপরীত লিঙ্গের কাওকেই ভালোবাসতে বলেছে, তার সাথে ঘর বাধতে বলেছে। কিন্তু আমরা যৌবনে পা দিয়ে টের পেয়েছি যে আমাদের পক্ষে তা কখনোই সম্ভব নয় (যারা উভকামী, তারা ব্যতিত)। এই মানসিক চাপে আমরা অনেকেই বড় হই বিষন্নতা নিয়ে, বড় একলা হয়ে। অনেকেই নিজের জীবনটা নিয়েও নিয়েছি নিজের ও পরিবার থেকে কষ্ট সহ্য করতে না পেরে। যারা বেঁচে আছি তাদের কেউ কেউ মনের দুঃখ আর নিঃসঙ্গতা ভুলতে গিয়ে বিভিন্ন প্রকার মদ ও মাদকের প্রতি ঝুঁকে জীবনটা নষ্ট করে ফেলেছি।

আমরা আর একলা নই। আমরা নেই দূর্বল। এই পাতাগুলোর সকল লেখা ও তথ্য দিয়ে আমরা একজন আরেকজনের পাশে এসে দাঁড়াবো। একজন আরেকজনকে সাহস যুগিয়ে দেব। এবং দেখিয়ে দেবো একজন যৌন সংখ্যালঘু হিসেবে কিভাবে এই সমাজে নিজের জায়গা নিজেকেই তৈরি করে নিতে হয়। তবে তা হবে আমাদের সবার ভালোবাসা আর সমর্থনের ছত্রছায়ায়। আমাদের মন দৃঢ় করার জন্য আমরা সারা দুনিয়ার যৌন সংখ্যালঘুদের আবহমান সংবাদের বাংলা অনুবাদ এখানে প্রকাশ করবো। আমরা জানবো যে এই পৃথিবীতে আমরা কেউ একলা নই। আর বিষমকামী সমাজে আমাদের যে সকল শুভানুধ্যায়ী রয়েছেন, তাদেরকেও আমাদের পাশে এসে দাঁড়ানোর অনুরোধ করবো। তাদের অবদান অপরিহার্য। বৈচিত্র্য একটা পরিবার, একটা সত্ত্বা, একটা গুন – একটা দেশ ও সমাজের সুন্দর একটা বহিঃপ্রকাশ।

সব শেষে আমরা মনে রাখবো যে ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসের শেষ নাগাদ ইসলামী জঙ্গীদের হাতে আমরা আমাদের দুই নক্ষত্র জুলহাজ মান্নান এবং মাহবুব তনয়কে হারিয়েছি এক নির্মম হত্যাকান্ডের মাধ্যমে। এরা ছিলেন যথাক্রমে একজন বাংলাদেশি সমকামী অধিকার কর্মী এবং একজন বাঙ্গালী সাংষ্কৃতিক কর্মী (নিজে সমকামী)। তাদের হারানোর অপুরণীয় ক্ষতি কিছুটা হলেও লাঘব করা সম্ভব হবে যদি আমরা আবারও একত্রে জোর গলায় কথা বলতে শিখি এবং ধর্মীয় মৌলবাদ, ঘৃণা, ও জঙ্গিবাদকে ভয় পেয়ে নিজের আড়ালে নিজেকে আর আবদ্ধ করে না রাখি। রূপবান পত্রিকার ভাষায় বলতেই হবে যে আমরা আছি, আমরা থাকবো।

*********************

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s