রিয়াজ ওসমানী
২৯ নভেম্বর ২০২০
অদৃষ্টের কী পরিহাস! হেফাজতিদের দাবির প্রেক্ষিতে সর্বোচ্চ আদালত থেকে যখন “লেডি জাস্টিসের” ভাস্কর্য সরানো হলো, যখন বাংলাদেশের কিছু পাঠ্যপুস্তক থেকে বাংলা সংষ্কৃতির কিছু বরেণ্য হিন্দু লেখক বা কবির কর্মগুলো সরিয়ে শুধু মুসলমানদের অবদানগুলো রাখা হলো, যখন ‘অ’ তে অজগর কে ‘অ’ তে অজু কর বানালো হলো, যখন কওমি মাদ্রাসার কোরাআন মুখস্ত করার শিক্ষা ব্যবস্থাকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রির মর্যাদা দেয়া হলো, তখন বাংলাদেশের সংষ্কৃতির উপর কোনো আঘাত আসেনি। আঘাতটা আসলো বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপন করা নিয়ে হেফাজতের বর্তমান আপত্তিটা আসার পর।
এর মানেটা হচ্ছে যে বাংলা সংষ্কৃতি নিয়ে আওয়ামী লীগের সম্প্রতি তেমন কোনো মাথা ব্যথাই ছিল না। কারণ, মাথা ব্যথাটা এলো বঙ্গবন্ধুর কিছুটা অবমাননা হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হওয়ার পর। এটা কিছুটা প্রত্যাশিত হলেও লীগের বিভিন্ন নেতারা এখন সংষ্কৃতির কথা বলে যতই অরণ্যে রোদন করুক না কেন, তাদের দ্বিচারিতা আমাদের কাছ থেকে লুকানো যাবে না। আর এর কারণ হচ্ছে যে হেফাজতের এই স্পর্ধা শেখ হাসিনা নিজেই তৈরি করে দিয়েছেন এবং ওনার চাটুকাররা আমাদের সাবধানতার বাণী সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছেন।
প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে আমাদের ক্রোধ ওনার চাটুকারদের উপর আরো দশ গুন বেশি প্রযোজ্য। আমরা যখনই উপরে উল্লেখিত লীগের পদক্ষেপগুলো নিয়ে আপত্তি তুলেছি, তখনই তারা “এটা আওয়ামী লীগের কৌশল” বলে মুখে ফ্যানা তুলে পার পেয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। আরে! আমরা তো “কৌশল” বা “কুশল” বুঝি না, আমরা বুঝি “ফল”। এবং তাদের কৌশলের ফল যে আজকের অবস্থা হবে, সেটা তো প্রথমেই বলে দিয়েছি। বসতে দিলে শুতে চায়, শুতে দিলে খাইতে চায়, খেতে দিলে থাকতে চায় – এই কথা তো আমাদেরই।
অথচ তখন এই চাটুকাররা আমাদের কথার কোনো পাত্তাই দেয়নি। আমাদেরকে “দেশ নেত্রীর উপর ভরসা রাখেন” ইত্যাদি দায়সারা গোছের কথা শুনিয়েছেন। এই বিষয়টা নিয়ে দেশ নেত্রীর উপর তখনও ভরসা রাখিনি, এখনও রাখছি না। আর চাটুকারদের তখনকার এবং এখনকার অবদানের জন্য তাদের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। এখন যদি লীগের আদমরা বাংলাদেশের প্রগতিশীল মানুষ, মুক্তমনা মানুষ বা নাস্তিকদের সহযোগিতা চায় তাহলে চাটুকারদেরকে প্রথমেই নিম্ন লিখিত দাবিগুলো মেনে নিতে হবে।
১) আমাদের কথা উপেক্ষা করে দলকানা হয়ে “কৌশল” শব্দটা বারবার উচ্চারণ করার জন্য আমাদের পায়ে ধরে মাফ চাইতে হবে।
২) সরকারকে বাধ্য করতে হবে হেফাজতকে নিষিদ্ধ করতে। এদের ভাবধারা একটা ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের পরিপন্থি।
৩) সরকারকে বাধ্য করতে হবে কওমি সনদ বাতিল করতে। কোরআন-হাদিস মুখস্ত করার বিদ্যাকে কখনই একটি আধুনিক এবং সর্বাঙ্গীণ বিদ্যার সমতূল্য ভাবা যাবে না।
৪) সরকারকে বাধ্য করতে হবে কওমি মাদ্রাসা চিরতরে বাংলার মাটিতে নিষিদ্ধ করতে। কারণ, এতে চাষ করা হয় একটি পশ্চাদমুখী এবং অকর্মন্য শিক্ষাব্যবস্থার আদলে ধর্ষিত ও নির্যাতিত কিছু সাংষ্কৃতিক প্রতিবন্ধীদের, যারা কেউই দেশের সমাজ ও অর্থনীতিতে কোনো উন্নয়নমূলক অবদান রাখতে পারে না, এবং যাদের মধ্যে কেউ কেউ জঙ্গিদের দলে যোগ দেয় বা জঙ্গিদের মতো মনোভাব নিয়ে জীবন অতিবাহিত করে।
৫) সরকারকে বাধ্য করতে হবে পাঠ্যপুস্তকের ধর্মনিরপেক্ষ রূপ পুনরায় ফিরিয়ে আনতে।
৬) সরকারকে বাধ্য করতে হবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সম্পূর্ণ বাতিল করতে।
৭) বাংলাদেশের সংবিধানের শুরুতেই লিখে দেয়া বিস্মিল্লাহির-রহ্মানির রহিম বাদ দিতে হবে। এই সংবিধান শুধু বাংলাদেশের মুসলমানদের জন্য নয়।
৮) সরকারকে বাধ্য করতে হবে সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম উঠিয়ে দিতে। সংবিধানের একটা রাষ্ট্রধর্ম থাকা মানেই সেই ধর্মের বাইরে সকল মানুষদেরকে রাষ্ট্রীয়ভাবে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক বানিয়ে দেয়া।
কেবল মাত্র আওয়ামী লীগের স্বার্থে আঘাত লাগলেই তারা আমাদের কাছে আসবে, অথচ ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য তারা দেশ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও বাংলা সংষ্কৃতি জলাঞ্জলি দিবে এবং আমরা সেটার প্রতিবাদ করলে আমাদেরই মুখ চেপে ধরবে, সেই সুবিধাবাদী মনোভাবের প্রশ্রয় আমরা দিব না। আশা করি হেফাজতের (এবং খেলাফতের) এখনকার দেশদ্রোহী আচরণ প্রধানমন্ত্রী, আওয়ামী লীগ এবং সকল চাটুকারদের জন্য একটা চির সতর্কীকরণ হয়ে থাকবে। আমাদের বাণী উপেক্ষা করে আমাদেরকে রাজনৈতিকভাবে গৃহহীন করে দেয়ার ফলাফল বাংলাদেশের জন্য কখনই ভালো হবে না। সেটা অনুধাবণ করতে ব্যর্থ হওয়ার জন্য লীগকে অত সহজে ক্ষমা করে দেয়া যাবে না।