রিয়াজ ওসমানী
২২ জুলাই ২০২০
এই প্রচ্ছদটি মার্ক জুকারবার্গ তথা সাধারণ ফেসবুক কতৃপক্ষের উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট করা হলো। আমি এখানে তুলে ধরতে চাই যে ফেসবুক কতৃপক্ষ জেনে বা না জেনে বাংলাদেশের অসংখ্য নাস্তিক, প্রাক্তন মুসলমান এবং মুক্তমনাদের একাউন্ট নিষ্ক্রিয় করে যাচ্ছে। এটা ধারণা করা যায় যে অন্য মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতেও একই অবস্থা বিরাজমান। বাংলাদেশের তরুণ এবং তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ জনগষ্ঠির জন্য ফেসবুক প্রায় অপরিহার্য হয়ে উঠেছে, যার সহায়ক হিসেবে কাজ করেছে সস্তা স্মার্ট মুঠোফোন এবং বাংলা ভাষায় স্থিতি দেয়া এবং মন্তব্য করতে পারার ক্ষমতা। এর ফলে দেশের ভেতর একটা প্রাণবন্ত অনলাইন জগত তৈরি হতে পেরেছে, যেখানে মানুষ এখন যোগাযোগ এবং কথোপকথন করতে পারে যা আগে সম্ভব ছিল না।
এই প্রাণবন্ত ফেসবুক জগতের একটা ঘটমান বিষয় হচ্ছে যে ইসলাম ধর্মের প্রচারকরা তাদের বক্তব্য ছড়িয়ে দেয়ার জন্য একটা নতুন মাধ্যম খুঁজে পেয়েছে। সমানভাবে, পূর্বে নিরব নাস্তিক, প্রাক্তন মুসলমান এবং মুক্তমনাদের গোষ্ঠীটিও মুমিনদের মনে গভীরভাবে ধরে রাখা বিভিন্ন অভিমতগুলোকে সংপ্রশ্ন করার একটা পথ খুঁজে পেয়েছে। নিম্নে বর্ণিত উদ্দেশ্য নিয়ে এই অবিশ্বাসী বিধর্মীরা নিজেদের উপর নিয়ে নিয়েছে কোরআন ও হাদিসের বিভিন্ন উক্তি নিয়ে আলোচনা করা দায়িত্বটি। মুসলমানরা বিশ্বাস করে যে কোরআন হচ্ছে সৃষ্টিকর্তার সার্বভৌম বাণী এবং হাদিস হচ্ছে নবী মুহাম্মদের বিভিন্ন বক্তব্যের সংকলন। বাংলাদেশের মতো দেশে কোরআন এবং হাদিস উভয়ই অলঙঘনীয়। কেউ কোনো প্রশ্ন করতে পারবে না, বরং সব কিছু বিশ্বাস এবং মান্য করতে হবে।
এর মধ্যে মজার বিষয় হচ্ছে যে বেশির ভাগ বাংলাদেশিরা মর্মগ্রহণ করতে পারে এমন একটা ভাষায় কোরআন বা হাদিস পড়েনি। কোরআন এবং হাদিস দুটোই লেখা হয়েছে শাস্ত্রীয় আরবি ভাষায় এবং বাংলা অনুবাদের দিকে মনোযোগ দেয়ার জন্য কোনো সামাজিক উদ্যোগ নেয়া হয়নি। অনেক অল্প বয়স থেকে শিশুদেরকে আরবি অক্ষর আর শব্দ উচ্চারণ করতে শেখানো হয়, এবং এর ফলে সময়ের সাথে সাথে পুরা কোরআন শরীফ উচ্চারণ করতে পারার ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। অনেককেই পুরাটা গ্রন্থ মুখস্ত করে ফেলতে উৎসাহ দেয়া হয়। কিন্তু এই প্রক্রিয়ার মাঝে বাদ পড়ে যায় কী পড়া হচ্ছে তার কোনো উপলব্ধি। বাংলাদেশ তথা আরবি ভাষা বলা হয় না অধিকাংশ এমন সব দেশের বেশির ভাগ মানুষরাই প্রতিদিন কী পাঠ করছে তার বিস্তারিত জ্ঞান আয়ত্তে রাখে না।
এই বইগুলোতে কী আছে তা বিভিন্ন ইমাম বা হুজুররা মসজিদে বা অন্য কোনো ধর্মীয় সমাবেশে কী বয়ান দিচ্ছে তার উপর নির্ভরশীল। এই সব মওলানা, শিক্ষক এবং বিদ্বানরা বাছাইকৃতভাবে কোরআন এবং হাদিসের অনুবাদ এবং ব্যাখ্যা তুলে ধরেন যাতে এতে করে জনগণের মাঝে সর্বদা একটা ইতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হয়। এই বাছাইকৃত উক্তিগুলোই ইসলামের নবীন ও প্রবীণ অনুসারীরা হৃদয়ঙ্গম করে সময় এবং সুযোগ বুঝে পুনরাবৃত্তি করে বেড়ায়। এই নির্বাচিত জ্ঞান ভান্ডারই হচ্ছে বাংলাদেশে অধিকাংশ মুসলমানদের বিশ্বাসের ভিত্তি এবং ধর্মগ্রন্থগুলোকে গভীরভাবে পর্যালোচনা করাটাকে জোরালোভাবে উৎসাহিত করা হয় না। সেটা প্রচারক এবং বিদ্বানদের উপরেই ছেড়ে দেয়া হয়।
বাংলাদেশে নাস্তিক, প্রাক্তন মুসলমান এবং মুক্তমনারা ফেসবুকের মাধ্যমে সুযোগ পেয়েছে কোরআন ও হাদিসের সেই উক্তিগুলো তুলে ধরার, যেগুলো প্রচারকরা এতো দিন কৌশলে এড়িয়ে গিয়েছেন। ১৪০০ বছরের বেশি সময় ধরে পুরুষ শাসিত ইসলামী সমাজগুলোতে যেই উক্তিগুলো ব্যবহার করে নারী, যৌন সংখ্যালঘু এবং কাফেরদের পদমর্যাদা ক্ষুণ্ণ করা হয়েছে তা তুলে ধরে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এর ফলশ্রুতিতে ফেসবুকের অনেক মুসলমান সদস্যদের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে এবং আলোচ্য পোষ্টগুলো ইসলাম ধর্ম এবং মুসলমান সম্প্রদায়ের মর্যাদা বিনষ্ট করেছে বলে সেই সদস্যরা অভিযোগ করেছে। যেহেতু উপরের বিষয়বস্তু নিয়ে অধিকাংশ স্থিতি এবং মন্তব্যগুলো বাংলা ভাষায় করা হয়েছে, সেহেতু ফেসবুকের যথেষ্ট সম্বল নেই রাগান্বিত ফেসবুক ব্যবহারকারীদের সকল অভিযোগ তদন্ত করে দেখার। একজন নাস্তিক, প্রাক্তন মুসলমান বা মুক্তমনার স্থিতি বা মন্তব্যগুলো যদি মুসলমান ব্যবহারকারীদের দ্বারা নিয়মিত কিছু অভিযোগের শিকার হয়, তাহলে ফেসবুক দিন শেষে যে মানুষটা সেই স্থিতি বা মন্তব্যগুলো দিয়েছেন তার একাউন্ট নিষ্ক্রিয় করে ফেলে।
অন্যদিকে যখনই আমরা বাংলাদেশে সকল সমকামী এবং নাস্তিকদের খুন করে ফেলার উদ্দেশ্যে মুসলমান মৌলবাদীদের দ্বারা প্রকাশ করা বিভিন্ন স্থিতির অভিযোগ করি, তখনই আমরা একটি প্রস্তুত করা উত্তর পেয়েছি যে উক্ত স্থিতিগুলো ফেসবুক সম্প্রদায়ের নীতিমালা লঙ্ঘন করেনি। আসলেই তাই?
আমার মনে হয় মার্ক জুকারবার্গ আমার সাথে একমত হবেন যে নারী, সমকামী এবং বিধর্মীদেরকে দমিত করে রাখার জন্য, এবং সম্প্রতিকালে মুসলমান ও অমুসলমান দেশগুলোতে সবচেয়ে নিকৃষ্ট সন্ত্রাসী কার্যকলাপ ঘটানোর জন্য কোরআন ও হাদিসের বিভিন্ন আয়াত বা উক্তিগুলোকে কীভাবে ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলো বিশ্লেষণ করাটা ইসলাম বিদ্বেষী মনোভাব পোষণ করা, বা একটি বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়কে কালিমালিপ্ত করার শামিল নয়। বরং এটা একটা উপযুক্ত আলোচনা, প্রসঙ্গক্রমে যেটা ইসলাম ধর্মে নিষিদ্ধ। অদৃষ্টের পরিহাস এই যে আমরা বাংলাদেশি নাস্তিক, প্রাক্তন মুসলমান এবং মুক্তমনারা এখন আমাদের কন্ঠগুলোকে রুদ্ধ পাচ্ছি এবং আমাদের বাকস্বাধীনতা খর্বিত দেখছি, কারণ ধর্ম বিশ্বাসীদের কাছ থেকে বিভিন্ন অভিযোগ পাওয়ার পর ফেসবুক আমাদের একাউন্টগুলো নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছে।
আমি আশা করি যে মার্ক জুগারবার্গ আমার সাথে একমত হবেন যে ইসলামের মতো ধর্মগুলো কীভাবে মুক্তচিন্তা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের বিকাশ, যৌনতার স্বাধীনতা, এবং বিজ্ঞান মারফত জ্ঞান অর্জনকে সাধারণভাবে দমন করে রেখেছে, সেগুলো নিয়ে আলাপচারিতা করাটা একটি ন্যায্য প্রচেষ্টা। ইসলাম হচ্ছে একটি গাঁথাই করে লিখে দেয়া ধর্ম যা ১৪০০ বছর আগেরকার আরব মুরুভূমির স্থানীয় বাস্তবতার উপর উদিত। ইসলাম নিজেই একটি পূর্ণাঙ্গ এবং অপরিবর্তনীয় জীবনধারা হিসেবে নিজেকে ঘোষিত করেছে এবং এই ধর্মের অনুসারীদেরকে এর ব্যতিক্রমী জীবন যাপন করতে নিষেধ করে দিয়েছে। তবে অধিকাংশ মুসলমানরা নিজেদের সুবিধা-অসুবিধার সাথে সামঞ্জস্য রেখে এই পূর্ণাঙ্গ জীবনধারার বিশেষ কিছু দিকগুলো বাছাই করে গ্রহণ করে নিয়ে নিজেদেরকে বড় ধার্মিক ও ন্যায়নিষ্ঠ মুসলমান বলে দাবি করে। এই কপটতাকে নিন্দা করাটা একটা উপযুক্ত প্রয়াস, বিশেষ করে যেহেতু এই ভন্ডামির ছত্রছায়ায়েই যেসকল মুসলমানরা উপরের এই মানুষদের চেয়েও কম ইসলামী জীবনধারা মেনে চলে, তাদের থেকে শুরু করে অন্য ধর্মালম্বী, ধর্মত্যাগী এবং মুসলমান ও অমুসলমান যৌন সংখ্যালঘুদেরকে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়।
মাদরাসা নামক ইসলামী অধ্যয়ন কেন্দ্রগুলোতে গরীব এবং অল্প বয়সের এতিম বালক ছাত্রদেরকে যে বলাৎকার (ধর্ষণ) করা হয় এবং তাদের উপর যে অন্যান্য শারীরিক অত্যাচার বেসানো করা হয় সেটাকে সবার দৃষ্টিগোচরে আনা একটা ন্যায্য আলোচনা। এই সমলৈঙ্গিক আবাসিক মাদরাসাগুলোর শিক্ষক এবং অপেক্ষাকৃত বড় বয়সের পুরুষ ছাত্রদের দ্বারা ছোট বালকদের নিয়ে এই ঘটনাগুলো ঘটে থাকে। বহু ইমামরা যে নিজেরাই অল্প বয়সের কিশোরী এবং নারী ধর্ষণের সাথে জড়িত সেটা তুলে ধরা একটা উপযুক্ত বিষয়। শিশু এবং নারীদের উপর শারীরিক অত্যাচারের ঘটনাবলি নতুন করে কিছু বলার অপেক্ষা রাখে না।
এটা একটা উপযুক্ত আলোচনা যেখানে নবী মুহাম্মদের জীবনকে সবার দৃষ্টিগোচরে আনা হয়, এমন কি সেই দিকগুলোও, যেগুলো ধর্মগ্রন্থ মোতাবেক তার বিবাহিত জীবন এবং যৌন সম্পর্কের মতো ব্যক্তিপরিসরে প্রবেশ করে ফেলে। নবী মুহাম্মদের জীবনের সকল দিকগুলোই পর্যালোচনার জন্য উপযুক্ত, শুধু বাছাইকৃত কিছু দিক নয়, যেহেতু বাংলাদেশে (এবং অন্য দেশে) অধিকাংশ পুরুষ মুসলমানরা প্রকাশ্যে নবীর পদক্ষেপ অনুসরণ করার ইচ্ছা ব্যক্ত করে থাকে (নবীর ব্যক্তিগত পরিচর্যা সহ)।
কোরআন এবং হাদিসে বর্ণিত ইসলাম ধর্মের প্রামাণিকতা এবং ইতিহাসকে প্রশ্ন করাটা একটি ন্যায্য আলাপচারিতা। একজন মুক্ত চিন্তাশীল মানুষ হিসেবে কোরআন এবং হাদিসের সত্যতা এবং কীভাবে এই বইগুলোর আগমন ঘটলো, সেটাকে প্রশ্নবিদ্ধ করাটা ন্যায়সঙ্গত। এবং ইসলাম বা অন্য যে কোনো সংগঠিত ধর্মের আদলে একটি বিশ্বাস ভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গিকে সংপ্রশ্ন করা একটি বৈধ অধিকার। এই বিশ্বাস ভিত্তিক দর্শন, যেটা “আমি বিশ্বাস করি বলেই ইহা সত্য হইবেই” – এই জাতীয় একটি ধারণা পোষণ করে থাকে, সেটা সকল যুক্তিযুক্ত বিতর্ক এবং প্রতিপাদনের পরিপন্থী।
জনাব জুকারবার্গ, আমার নিজেরটা সহ আমাদের অনেকেরই ফেসবুক একাউন্ট নিষ্ক্রিয় করে ফেলা হয়েছে। আমরা এটাও মনে করি যে ফেসবুক বাংলাদেশের মত দেশেগুলোর সরকারের তরফ থেকে আমাদের কন্ঠরোধ করার অনুরোধের কাছে মাথানত করছে। এখানেই ফেসবুক বাকস্বাধীনতা রক্ষা এবং পৃথিবী জুড়ে মানুষদের মাঝে যোগাযোগ স্থাপন করার জন্য তার নিজের অঙ্গীকারে ব্যর্থ হচ্ছে। এবং ফেসবুক আমাদের সাথে এমনটা করছে এমন একটা পটভূমিতে, যখন কয়েক বছর আগেই ইসলামের নামে বাংলাদেশে ইসলামী জঙ্গিরা বেশ কিছু নাস্তিক, প্রাক্তন মুসলমান, মুক্তমনা, লেখক, ব্লগার, ভিন্ন ধর্মের নেতা, সংষ্কৃতিমনা এবং সমকামী অধিকার কর্মীদের হত্যা করে। সাধারণভাবে বলা যায় যে দেশের মুসলমানরা এই সব ঘটনাগুলোর জন্য কোনো আফসোস প্রকাশ করেনি। কারণ যাদের প্রাণ চলে গিয়েছে তারা সেই মুসলমানদের ধর্মেরই সমালোচনা করেছে বা সেই ধর্মের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ জীবন যাপন করেছে। দেশের সরকারের সামগ্রিক রাজনৈতিক অবস্থানও ঠিক এমনটাই ছিল। এবং জনাব জুকারবার্গ, আপনি কি জানেন যে এই সব হত্যাকান্ডগুলোর ইন্ধন কোথায় যোগানো হয়েছিল? সয়ং ফেসবুকেই।
আমি আশা করছি যে আপনি এবং আপনার কর্মীগন গুরুত্ব সহকারে এই বিষয়টা খতিয়ে দেখবেন। আমাদের একাউন্টগুলো পুনরায় সক্রিয় করতে হবে, এবং ইসলাম ধর্ম সংক্রান্ত ন্যায্য আলোচনা এবং সমালোচনাকে যাতে দমন করা না হয়, তার জন্য উপযুক্ত কার্যপ্রণালী বাস্তবায়ন করতে হবে। উপরন্তু, ফেসবুকে বাংলা ভাষায় পারদর্শী যথেষ্ট ব্যক্তিদের কর্মনিয়োগ দিতে হবে, যাতে করে আপনার কর্মীবর্গের সদস্যরা নিখুঁতভাবে সংশ্লিষ্ট স্থিতি এবং মন্তব্যগুলো পরখ করে দেখতে পারে এবং সেগুলো নিয়ে উপযুক্ত সিদ্ধান্তে পৌছতে পারে।
অনেক ধন্যবাদ জনাব জুকারবার্গ। বাংলাদেশ এবং বিশ্ব জুড়ে সকল নাস্তিক, প্রাক্তন মুসলমান এবং মুক্তমনাদের জানাই আমার শ্রেষ্ঠ কামনা।