রিয়াজ ওসমানী
১৭ মে ২০২০
বাংলাদেশী লিখবো, না কি বাংলাদেশি লিখবো? রাণী, না কি রানি? ইদানীং কালে এই বিড়ম্বনা বেশ প্রকট হয়ে উঠেছে। এর কারণ সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকারি উদ্যোগে বাংলা একাডেমি মারফত বাংলা বানানের কিঞ্চিৎ সরলীকরণ এবং কিছু নিয়মের আওতায় সীমাবদ্ধকরণ। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম, যেই প্রতিষ্ঠানটি এখনো পর্যন্ত তাদের নামটাও বাংলায় সঠিকভাবে রাখতে পারেনি তাদের এই শিশুসুলভ বাতুলতাকে গুরুত্ব সহকারে দেখার কোনো প্রয়োজন আছে কি না। তাছাড়া আমরা এত দিন কি ভুল শিখেছি বা লিখেছি? ভুলই যদি করেছি তাহলে কোন নিয়ম অনুযায়ী ভুল লিখেছি? আর ভুলই যদি করেছি তাহলে এখনকার যে নতুন নিয়ম প্রণয়ন করা হলো সেগুলো কোন নিয়মে করা হয়েছে? আগেকার প্রতিষ্ঠিত রীতি অনুযায়ী, না কি নতুন করে বানানো কিছু রীতি অনুযায়ী? নতুন করে বানানো কিছু হলে সেটাতে আমার ছিল ঘোর আপত্তি।
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর কেউ আমাকে সঠিকভাবে দিতে পারেনি। আমিও নেটে অনেক অনুসন্ধান করেও কোনো উপসংহারে আসতে পারিনি। পরে বুঝলাম আমার প্রশ্নগুলোই ছিল ভুল। এখানে ব্যাপার হচ্ছে যে এত দিন ধরে বিভিন্ন শব্দের প্রচলিত বানানের মধ্যে ছিল কিছু অরাজগতা। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় – একই রকম দুইটা শব্দ ছিল অথচ একটাতে ছিল ইকার, আরেকটাতে ছিল ঈকার এবং সেই বিশৃঙ্খলা কোনো নির্দিষ্ট কারণ ছাড়াই বলবৎ ছিল। তার উপর একেকজন ভিন্নভাবে শব্দ দুটো লিখে গেছেন। এই অরাজগতা দূর করতে বাংলা বানানের একটা সরলীকরণ এবং মানদণ্ডের প্রয়োজন ছিল। বাংলা একাডেমি এই মানদণ্ড ও ছক তৈরি করে প্রতিটি নিয়মের ব্যাখ্যাও দিয়েছে। আমার আবারও প্রশ্ন থেকে যায় যে কিসের ভিত্তিতে তারা এই সব নিয়ম তৈরি করলো। তারা যেগুলোর বর্ণনা করেছে সেগুলোর কি কোনো ভাষাভিত্তিক এবং ঐতিহাসিক দলিল রয়েছে? নাকি এই নিয়মগুলো তাদের ইচ্ছে মত তৈরি করা হলো?
আরো ভেবে দেখলাম যে এই প্রশ্নটা আর মুখ্য নয়। তারা তাদের নিয়মের ব্যাখ্যা দিয়েছে এবং সংষ্কৃত ভাষার গঠনের কিছু কথাও বলেছে যেগুলো আমার সহজে বোধগম্য হয়নি। কিন্তু আস্তে আস্তে বুঝলাম যে এগুলো আমার অত ভালো করে এখন না বুঝলেও চলবে। একটা নিয়ম বা শৃঙ্খলা তৈরি করে দেয়া হয়েছে, সেটাই যথেষ্ট। কারণ, আমার কাছে একটাই জিনিষ গুরুত্বপূর্ণ। সেটা হচ্ছে যে সবাইকেই একভাবে একটা শব্দ লিখতে হবে। দুই বা তিনভাবে নয়। আর এখানেই বাংলা একাডেমির প্রচেষ্টা স্বার্থক বলে আমি মনে করি। অন্তত বাংলাদেশের ভেতরে সবাইকে সরকারি অনুমদিত এই বানানের রূপরেখা মেনে নেয়া উচিৎ। কিছু ভাষা বিশেষজ্ঞ এই নতুন নিয়মগুলোর কোনোটাকে যৌক্তিক মনে করতে পারেন, কোনোটাকে অযৌক্তিকও মনে করতে পারেন। সেটা তাদের অধিকার। কিন্তু একটা নীতিমালা যেহেতু আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে, আসুন আমরা সবাই এই ছকের আওতায় আসি। তথ্যপ্রযুক্তির যুগে বাংলা বানানের একটা নির্দিষ্ট রূপরেখা যে অপরিহার্য, আশা করি সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। শুনেছি চীনেও নাকি তথ্যপ্রযুক্তির কারণে তাদের হাজারটা শব্দ সরলীকরণ করে ফেলা হয়েছে।
এখন বাংলা বানান নিয়ে পশ্চিম বাংলার সাথে বাংলাদেশের একটা বিভাজন তৈরি হয়ে যেতে পারে। তবে বানান নিয়ে এই বিভাজন নতুন কিছু নয়। ইংরেজি ভাষার ক্ষেত্রেও আমরা দেখেছি যে মার্কিনরা অনেক ইংরেজি শব্দ সরলীকরণ করে বদলে ফেলেছে যেগুলো ইংরেজদের ভ্রু কুচকিয়ে ফেলে। বাংলাদেশে যেহেতু বাংলা বানানের জন্য একটা প্রণালী আনুষ্ঠানিকভাবে তৈরি করে ফেলা হয়েছে, আমাদের উচিৎ সেটাকে গ্রহণ করে নেয়া, এখন থেকে এইভাবে লেখার অভ্যাস করা এবং ছোটদেরকে এইভাবে শিক্ষা দেয়া। এতে বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠানিক রূপকে আরও পোক্ত করা হবে। নিম্নে দেয়া সংযুক্তিটি বাংলাদেশ সরকারের প্রজ্ঞাপনের। আমার সাথে আপনারাও এখানে দেয়া বানান প্রক্রিয়াগুলো রপ্ত করে নিতে পারেন। আমি এই কাজ কেবল শুরু করতে যাচ্ছি বলে আমার এই লেখায় বাংলা একাডেমির বানান স্পষ্টভাবে ফুঁটে উঠেছে বলে আমি বিন্দু মাত্র দাবি করতে পারছি না।