রিয়াজ ওসমানী
৮ জুন, ২০২০
যুক্তরাষ্ট্রে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া এক শ্বেতাঙ্গ (সাদা) পুলিশ কর্মচারীর হাতে এক কৃষ্ণাঙ্গ (কালো) পুরুষের মৃত্যুর ঘটনা আজ নতুন কিছু নয়। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হচ্ছে যে এই ঘটনাগুলো সেই দেশে একটা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। মুঠোফোনের সুপ্রসারিত ব্যবহার আগেরকার দিনে বলবৎ না থাকায় আগের অনেক হত্যাকান্ডগুলোর যথাযথ বিচার হয়নি। অনেক সাদা পুলিশ কর্মকর্তারা বিনা বিচারে পার পেয়ে গিয়েছে। কিন্তু এবার আর নয়। এবার আমেরিকা জেগে উঠেছে, বিশ্ব জেগে উঠেছে।
এই করুন অবস্থার ইতিহাস জানতে হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সৃষ্টির দুটি আদি কলঙ্ক (অরিজিনাল সিন) সম্বন্ধে অবগত হতে হবে। প্রথমটা হচ্ছে যুক্তরাজ্য থেকে যখন শ্বেতাঙ্গ মানুষগুলো ১৬০০ সালের পর থেকে বর্তমান যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিষ্ঠে জাহাজে করে উপস্থিত হতে শুরু করলো, তারপর থেকে সেখানে অনেক দিন ধরে বাস করা আদিবাসী, যাদেরকে এখন “নেটিভ আমেরিকান” বলে আখ্যায়িত করা হয়, তাদের জায়গা ও জমি দখল করে নেয়া হয়, তাদের বিরুদ্ধে হত্যাকান্ড ঘটানো হয় এবং তাদেরকে দীর্ঘ দিনের জন্য সীমিত সংরক্ষিত এলাকা (রেসার্ভেশন)এ বাস করতে বাধ্য করা হয়। তাদের কাছ থেকে প্রচুর এলাকা পেয়েই আস্তে আস্তে সেই বিলেতি আগন্তুকরা এবং পরে আরও ইউরোপীয়রা আমেরিকার সেই বিরাট অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে। প্রথম সেই দিনগুলোতে সেই অঞ্চলটা ছিল বিশ্ব জুড়ে বিলেতি সাম্রাজ্যেরই একটা অংশ। বিলেতিদের বিরুদ্ধে অনেক বিদ্রোহের পর ১৭৭৬ সালে ৪ জুলাই, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটা স্বাধীন দেশের স্বাদ লাভ করে।
ধর্মীয় গ্রন্থের সমতূল্য তাদের লিখিত সংবিধানে সকল মানব সমান – এই বলে অনেক কথা বলা থাকলেও সেটার যথাযথ বাস্তবায়ন মার্কিনিরা আজও দেখতে পায়নি। সেই ১৬০০ সালের পর থেকেই বিলেতি কৃতদাস বনিকদের সহায়তায় বিলেতি সাম্রাজ্যবাদের অধিনস্ত আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষ, নারী ও শিশুদের জোর করে ধরে ধরে জাহাজে করে আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চলে নিয়ে আসা হয় তুলার খামারে দাস হিসেবে কাজ করার জন্য। নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে নিয়ে আসা এই মানুষদেরকে স্থানীয় শ্বেতাঙ্গদের কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়। তাদেরকে নিয়ে আসার জন্য যেই সব জবরদস্তি খাটানো হয় তা ছিল শক্ত লোহার শিকল দিয়ে অবরুদ্ধ করে রাখা এবং অমানবিক প্রহার করা। জাহাজগুলোর বৈঠাগুলোও তাদেরকে পিটিয়ে পিটিয়ে তাদেরকে দিয়েই চালানো হয়। পর্যায়ক্রমে দলে দলে আরও অনেক কালো মানবরা আজকের যুক্তরাষ্ট্রে এসে পৌছে এক অজানা দেশে দাস হয়ে জীবন যাপন শুরু করতে, যেখানে তারা তাদের সাদা মনিবদের কাছ থেকে আরও প্রহার সহ্য করা সহ জন্তু-জানোয়ারের মত বাস করতে থাকে।
এটাই হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সৃষ্টির দ্বিতীয় কলঙ্কটি। অনেক দিন পর্যন্ত এই জন্তু-জানোয়ারের মত মানুষরা বংশ বিস্তার করলেও তারা ছিল তাদের সাদা মনিবদের কৃপার পাত্র। স্বাধীনতা লাভের পর আমেরিকাকে বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে গঠিত করা হয় (যার কারণেই দেশটির নামে আছে যুক্তরাষ্ট্র)। এবং উওর-পূর্ব অঙ্গরাজ্যগুলো দক্ষিণের অঙ্গরাজ্যগুলোতে বলবৎ থাকা দাসপ্রথার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। এই অবস্থা এক সময়ে এতোটাই প্রকট হয়ে ওঠে যে পুরো দেশ জুড়ে ১৮৬১ সালে চার বছরের জন্য একটা গৃহযুদ্ধ সংঘটিত হয়। দক্ষিণ অঙ্গরাজ্যগুলো কিছুতেই দাসপ্রথা বিলুপ্ত করতে চাচ্ছিল না। করলে তাদের খামারগুলোতে কাজ করবে কে? তারা এই লক্ষ্যকে ঘিরে উত্তর অঙ্গরাজ্যগুলো থেকে আলাদা হয়ে আরেকে স্বাধীন দেশ হয়ে যাওয়ার ব্রত নিয়েছিল। কিন্তু উত্তরাঞ্চলের সেনারা সেটা হতে দেয়নি এবং ১৮৬৫ সালের ৯ এপ্রিল, দক্ষিণের সেনারা হেরে যায়। গৃহযুদ্ধে অনেক প্রাণহানী ও ধ্বংসযজ্ঞের পর যুক্তরাষ্ট্র অটুট থাকে এবং ১৮৬৫ সালের ৩১ জানুয়ারীতে পুরা দেশ জুড়ে দাসপ্রথা আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত করা হয়।
কৃষ্ণাঙ্গরা এরপর থেকে মুক্ত হয়ে অনেকেই দক্ষিণ থেকে উত্তরের অঙ্গরাজ্যের বিভিন্ন শহরে এসে ভিড় জমায় বিভিন্ন কলকারখানায় কাজ করতে। দক্ষিণে রয়ে যাওয়া কালোরা বাসস্থান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র, বিনোদন কেন্দ্র এমন কি পানি পান করার ফোয়ারাতেও তুমুল পৃথকীকরণ এবং পৃথকীভবনের শিকার ছিল। তারা সেখানে নিঃসন্দেহে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের মর্যাদাও পায়নি। তবে কৃষ্ণাঙ্গ নেতা সন্মানিত মার্টিন লুথার কিং এর নেতৃত্বে বিগত শতাব্দির মাঝামাঝি সময়ে কালোরা জেগে ওঠে। মহাত্মা গান্ধীর আদর্শে অসহযোগ আন্দোলনে মেতে ওঠে তারা। এবং এর ফলে ১৯৬৪ সালে দক্ষিণের সকল পৃথকীকরণ এবং পৃথকীভবন বিলুপ্ত করা হয় এবং অন্তত কাগজে কলমে যুক্তরাষ্ট্রের কালোরা সেই দেশের সমান নাগরিকের অধিকার পায়। তারা আজ সেই দেশের জনসংখ্যার ১৩-১৫%।
তবে ১৮৬৫ সালের পর থেকে উত্তরাঞ্চলে চলে আসা কালোরা যে সেখানে তাৎক্ষণিক সমান নাগরিকের সন্মান পেয়েছিল তা নয়। দক্ষিণ অঙ্গরাজ্যগুলোর মত আনুষ্ঠানিক বৈষম্য বলবৎ না থাকলেও উত্তরে কালোরা সাদাদের কাছ থেকে অনেক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বৈষম্য ও বর্ণবাদিতার শিকার ছিল। যার কারণে উত্তরাঞ্চলের অনেক শহরেই আজও কালোরা অধিকাংশই কিছুটা আলাদা ছিটমহল জাতীয় এলাকায় বাস করে। সেখানে তারা নিম্নমানের বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও নাগরিক সুবিধা পেয়ে থাকে। এর ফলে তাদের মধ্যে কেউ কেউ তুলনামূলকভাবে বেশি অপরাধেও জড়িয়ে পড়ে। নিম্ন শিক্ষার কারণে ভালো চাকরি-বাকরি করে অনেকেই এখনো উপরে উঠে আসতে পারেনি। এছাড়া সেই দেশের বাজার অর্থনীতিতেও কালোদের বিরুদ্ধে এখনো অনেক বাঁধা বিপত্তি রয়েছে। কালোদেরকে সহজে ব্যাংকের ঋণ দেয়া হয় না, বাড়ি ভাড়া দেয়া হয় না ইত্যাদি। মোট কথা একটা সাদা পরিবারে জন্ম নেয়া শিশু আমেরিকাতে যেই ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে পারে, একটা কালো পরিবারে জন্ম নেয়া শিশু সেই দেশে সমান ভবিষ্যত এখনো দেখতে পায় না।
কিন্তু সবচেয়ে মর্মান্তিক বিষয় হচ্ছে যে এখনো একজন কালো মানুষকে কেবল অপরাধের সন্দেহে সেই দেশের পুলিশ, যারা অধিকাংশই সাদা, তারা অধিকতরভাবে তল্লাশি করে, গ্রেফতার করে এবং সম্প্রতি ঘটনা অনুযায়ী খুনও করে ফেলে। অপরাধের সন্দেহে খুন হয়ে যায় এই পরিণতি আমেরিকাতে আমরা সাদা পুলিশের হাতে কালোদের কপালেই দেখি। এবং বিগত কয়েক দশক ধরে সাদা পুলিশদেরকে এই জঘন্য ঘটনাগুলোর জন্য জবাবদিহি করাতে শুরু করা হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে যথাযথ প্রমাণাদি এবং প্রশাসন ও বিচার বিভাগের সদিচ্ছার অভাবে অধিকাংশ খুনি পুলিশরা বিনা বিচারে পার পেয়ে গেছে।
দাসপ্রথা এবং পৃথকীভবনের ইতির পর অধিকাংশ মার্কিনি সাদাদের মধ্যে একটা ধারণা এসে গিয়েছিল যে সকল ঝামেলা মিটে গেছে – কালোরা এখন মুক্ত এবং সাদাদের বাপ-দাদাদের পাপের বোঝা তারা আর বহন করবে না। এই মানসিকতার ফলে কালোরা যখনই বর্তমানকালে রয়ে যাওয়া সকল প্রাতিষ্ঠানিক বর্ণবাদিতার অভিযোগ তুলেছে, সাদাদের প্রবণতা ছিল অন্য দিকে তাকিয়ে সেই সকল অভিযোগ অস্বীকার করা এবং কালোদের কথাগুলো বিন্দুমাত্র কর্ণপাত না করা। এবং এর ফলেই পুলিশি বর্বরতা সহ অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক বর্ণবাদিতা আজও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিদ্যমান।
মার্কিন রাষ্টপ্রতি ডোনান্ড ট্রাম্পের জঘন্য রাজনীতি সত্যেও এই বার আমেরিকায় আমরা পরিবর্তন আশা করতে পারি। শ্বেতাঙ্গ তরুণদের মাঝে সচেতনতা এসেছে যে তাদের কৃষ্ণাঙ্গ বন্ধু-বান্ধবদের জীবন তাদের চেয়ে এতোটা ভিন্ন হওয়াটা মার্কিন চেতনার সম্পূর্ণ পরিপন্থি। তবে সকল বয়সের সাদারা যদি আত্মবিশ্লেষণে মগ্ন হয়ে কালোদের মনের কথা এবং অনুভূতির কথা গভীরভাবে মনোযোগ দিয়ে শুনে অনুধাবণ করতে শিখে তবেই কাঙ্খিত পরিবর্তগুলো আনা সম্ভব। এখনো অনেক সাদা পরিবারের সান্ধ্যকালীন ভোজনের একটি প্রিয় আলাপের বিষয়বস্তু কালোদের নিয়ে নানা উপহাস।