রিয়াজ ওসমানী
১৪ জুন ২০২০
এই শিরোনাম দিয়ে লেখার তৃতীয় পর্ব এই বলে শেষ করেছিলাম যে যুক্তরাজ্যে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে এই দেশের কালো ও বাদামী (ভারত উপমহাদেশীয়) রঙের মানুষরাই বেশি প্রাণ হারিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রেও কালোরা তুলনামূলক হারে অনেক বেশি মৃত্যু বরণ করেছে এই মহামারীতে। এর সমস্ত কারণ ভবিষ্যতে ডাক্তার, বিজ্ঞানী ও সমাজ বিজ্ঞানীদের কাছ থেকে জানার অপেক্ষায় রইলাম। এই পর্বে কৃষ্ণাঙ্গ (কালো) মানুষের প্রতিকূল ও বর্ণবাদী এই দুনিয়ায় আমরা যারা ভারত উপমহাদেশীয়, তাদের অবস্থান, অবদান ও দায়িত্ব কি থাকতে পারে তা নিয়ে আলাপ করবো।
প্রথমে বলতে হবে তাদের কথা যাদেরকে বিলেতি সাম্রাজ্য চলাকালীন সময়ে ভারত উপমহাদেশ থেকে আফ্রিকা মহাদেশে কাজের লোভে নিয়ে যাওয়া হয় এবং “কুলি” বলে আখ্যায়িত করা হয়। উগান্ডা, কেনিয়া, তানজানিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকায় তারা পাড়ি জমায় রেল খাত, দাপ্তরিক খাতের বিভিন্ন নিম্ন স্তরের কাজ ইত্যাদিতে বিলেতি ঔপনিবেশিক শাসনকে সহায়তা করতে, কারণ সেই সকল কাজের জন্য বিলেতিরা স্থানীয় কালোদেরকে যথাযথভাবে বস করতে পারেনি। কালোদের জীবন থেকে কিছুটা উঁচু কিন্তু বিলেতি সাদাদের থেকে আর্থিক ও সামাজিক দিক থেকে নিচু স্তরে বদ্ধ থাকা এই ভারতীয়রা সময়ের সাথে সাথে স্থানীয় ব্যবসা-বানিজ্যে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলে। তাদের ছেলে ও মেয়েরা বিলেতিদের বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে ডাক্তার, প্রকৌশলী ইত্যাদিতে পরিণত হয়।
বুঝতেই পারছেন যে ইচ্ছা বা অনিচ্ছা করে বিলেতিরা আফ্রিকা মহাদেশে তাদের অধীনের দেশগুলোতে কালো ও সাদাদের মাঝে গায়ের রং, সমাজ ও অর্থনীতির বর্ণালীতে একটা মধ্য অস্তিত্ব তৈরি করে ফেলে যা কালো আফ্রিকানদের দমন ও শোষণের মাত্রাকে আরও তীব্র করতে সহায়তা করে। এবং সেখানে খুঁটি গড়া ভারত উপমহাদেশীয়রা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সেই শোষণে অবদান রেখেছে নিজেদের স্বার্থে, নিজের জীবন গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে। এদের পরবর্তি প্রজন্মরা এখনো আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের নাগরিক এবং কালো আফ্রিকানদের তুলনায় এরা সামাজিক ও আর্থিক দিক থেকে সুবিধাজনক অবস্থায় বাস করছে। এখানেও চামড়ার বর্ণ একটা অন্যায় পরিস্থিতির আহবায়ক হয়েছে।
তবে এই দেশগুলো বিলেতি শাসকদের কাছ থেকে স্বাধীন হওয়ার পর অনেকগুলোতেই সামরিক নেতারা ক্ষমতায় আসে। তারা কালোদের সত্যিকারের মুক্তির কথা বলে ভারতীয় নাগরিকদের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালায়। এর উদাহরণস্বরূপ আমরা দেখতে পাই যে ১৯৭২ সালে উগান্ডা দেশটির নেতা ইদি আমিন সেই দেশের ভারতীয় বংশের প্রায় সকল নাগরিকদের বহিষ্কার করে দেয়। প্রাক্তন শাসক দেশ যুক্তরাজ্য উগান্ডা থেকে বের করে দেয়া সকল মানুষদেরকে গ্রহণ করে নেয়। বহিষ্কৃত অনেকে যুক্তরাষ্ট্রেও পারি জমায়। যুক্তরাজ্যে আফ্রিকা থেকে আসা এই ভারতীয় বংশের মানুষরাই আজ সমগ্র ভারত উপমহাদেশ থেকে আসা মানুষদের তুলনায় সবচেয়ে বেশি সফল। কারণ তাদের ছিল আফ্রিকা থাকাকালীন সময়ে প্রাপ্ত বিলেতি শিক্ষা ও পেশাগত যোগ্যতা। বর্তমান সরকারের মেয়াদে এই দেশের অর্থমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী উভয়ই সেই গোত্রেরই মানুষ।
এবার আসি যুক্তরাষ্ট্রের দিকে। সম্প্রতি ও-পি ওয়ান এবং ডি-ভি ওয়ান ভিসার আওতায় সেই দেশে পৃথিবী থেকে নিম্ন স্তরের (অর্থনৈতিক, শিক্ষাগত এবং পেশাগত) মানুষরা পারি জমাতে পারলেও তার আগে ভারত উপমহাদেশ থেকে যারা যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন নিয়েছিল, তারা ছিল স্থানীয় মেধাবীরা যারা সেখানে গিয়ে বড় ডাক্তার, বিজ্ঞানী, অধ্যাপক ও ব্যবসায়ী হতে পেরেছে। তাদের উপার্জন মার্কিন গড় আয়ের চেয়ে উপরে এবং অর্থনীতি ও সমাজে তাদের ইতিবাচক ভূমিকার কারণে তাদেরকে এবং এশিয়া মহাদেশ থেকে আগত অন্যান্যদেরকে মার্কিনি শ্বেতাঙ্গ (সাদা) সম্প্রদায় এক সময়ে “আদর্শ সংখ্যালঘু” (মডেল মাইনরিটি, model minority) বলে আখ্যা দেয়। আমরা ভারত উপমহাদেশীয়রা মনের হরষে সেই আখ্যা লুফে নিয়েছি নিজেদের অজান্তে যে এই ধরণের খেতাব যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন বর্ণের ও জাতের মানুষদের মাঝে সম্প্রীতির ক্ষেত্রে ক্ষতিকর। গায়ের রং ও জাতের বর্ণালীতে নিজেদেরকে একটি বিশেষ রঙের মানুষদের (কালোদের) চেয়ে উঁচু ভাবতে এই শ্রেণিবিন্যাস আমাদেরকে সহায়তা করেছে যা দুঃখজনক। আমেরিকার কালোরা অলস, মদ ও মাদকখোর, অপরাধ প্রবণ ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ ও বিশ্বাসের কারণে বাংলাদেশিদের মুখে কালোদের বিরুদ্ধে কটু কথা শুনতে পাওয়া অস্বাভাবিক কিছু না। সাদাদের সঙ্গে আমাদের এভাবে সুর মেলানোর কোনো দরকার নেই।
আরো গভীরে গেলে আমাদের মাঝে বর্ণবাদিতার আরেক রকম বহিঃপ্রকাশ স্পষ্ট দেখা যায়। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশি মূলোদ্ভূত মার্কিনি ছেলে ও মেয়েরা কেউ কেউ অন্য জাতের মানুষদের সাথে প্রেমের সম্পর্ক করে বিয়েও করে। অন্য জাতটা সাদা হলে আমাদের প্রতিক্রিয়া এক রকম হয়। অন্য জাতটা কালো হলে আমাদের প্রতিক্রিয়াটা কী সেটা কি এখানে বর্ণনা করে দিতে হবে? নিজে অনুমান করে নিতে পারেন কি? সাদা হলে মন্দের ভালো আর কালো হলে সর্বনাশ! আমার এই পর্যবেক্ষণ কি মিথ্যে? কালোর চেয়ে এখানে সাদাদের একটু বেশি সহ্য করা বা মেনে নেয়া হচ্ছে কেন? আমি এখানে যারা সম্পর্ক করছে তাদের ব্যক্তিগত পছন্দের কথা বলছি না। বলছি তাদের এই সম্পর্ক বা বিয়ের কারণে বাংলাদেশি বা ভারত উপমহাদেশীয় পরিবারগুলোর প্রতিক্রিয়ার কথা। এই ব্যাপারটা আরো ভালোভাবে অনুধাবণ করতে চাইলে ১৯৯১ সালের মিসিসিপি মাসালা (Mississippi Masala) নামক ছবিটা দেখে নিন।
এবার আসি যুক্তরাজ্যের দিকে। একটু আগে বলেছি যে আফ্রিকা থেকে আসা ভারতীয় বংশের মানুষরা এই দেশে সবচেয়ে বেশি সফল। ভারত উপমহাদেশ থেকে আসা বাকিদের কথা এখন বলা দরকার। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর পাকিস্তানের মিরপুর অঞ্চল থেকে অনেক কম শিক্ষিত ও অর্থ সহ মানুষরা এই দেশে এসে বস্ত্র শিল্পে কাজ শুরু করে। স্বাধীনতার আগের থেকেই বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চল থেকে অল্প শিক্ষা আর আয়ের অনেক মানুষ এই দেশে এসে ভারতীয় রেস্তোরাঁ ব্যবসায় নিয়োজিত হয়ে যায়। ভারত থেকে শিক্ষিত ও কম শিক্ষিত উভয় মানুষরাই এই দেশে আসে স্থানীয় শ্রমিক সংকট কাটাতে সহায়তা করতে। তাদের মধ্যে অনেকে বিলেতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উচ্চ শিক্ষায়ও নিয়োজিত হয়ে যায়। তাই তাদের মধ্যে আজ অনেক উচ্চ আয়ের মানুষ দেখা যায় যারা ডাক্তার, অধ্যাপক ইত্যাদি। তবে নিজের ছেলে ও মেয়েদেরকে বিলেতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সুষ্ঠভাবে শিক্ষিত করার প্রবণতা পাকিস্তানি ও বাংলাদেশিদের তুলনায় ভারতীয়দের মধ্যেই সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে। পাঞ্জাবি, গুজরাতি এই গোত্রের বিলেতিরা আজ টিভির পর্দায় দৃশ্যমান।
পাকিস্তানি আর বাংলাদেশি বিলেতিরা দেরিতে হলেও তাদের ছেলে ও মেয়েদেরকে এখন লেখাপড়া শেখাতে শুরু করেছে। বাংলাদেশিদের ক্ষেত্রে বলা যায় যে সেই সব পরিবারের ছেলে ও মেয়েরা কিছুতেই রেস্তোরাঁ ব্যবসায় মন দিতে চায় না। তারা কষ্ট করে উপরেই উঠতে চায় যার ফল আমরা আস্তে আস্তে দেখতে পাচ্ছি সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে। তবে এদের এবং পাকিস্তানি অধ্যুষিত অনেকের মাঝেই ইসলাম ধর্মের অনেক গোঁড়ামি ঢুকে গেছে দেখে এদেরকে কালোদের মত পপ সঙ্গীত ও ফুটবল জাতীয় খেলাধূলায় বেশি দেখা যাবে বলে মনে হয় না! এদেরকে ভবিষ্যতে দাপ্তরিক পেশায় বেশি করে দেখা যাবে বলে মনে হচ্ছে। বিলেতি সরকারি স্বাস্থ্য সেবায় আজ বাংলাদেশি বিলেতিদের উপস্থিতি লক্ষণীয়।
বলে রাখা উচিৎ যে বাংলাদেশি বিলেতিদের ছেলেদের মধ্যে এক সময়ে কালোদের মত কিছুটা মাস্তানী আর মাদক আসক্তি লক্ষ্য করা গিয়েছিল। পরে অনেকেই ধর্মের আশ্রয় নিয়ে মৌলবাদী হয়ে গিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামিক স্টেট (আই এস) এ যোগ দিয়ে নিজের (ও অন্য মানুষের) জীবন বিপন্ন করে ফেলে। এদের মাঝে বাংলাদেশি অধ্যুষিত বিলেতি ছেলে ও মেয়ে উভয়েরই সংবাদ পাওয়া গেছে। তবে পরিষ্কার করে দিতে চাই যে ইসলামিক স্টেটে যোগদানকারীরা যে সবাই আগে মাস্তান আর মাদকখোর ছিল তা নয়। আবার সব গোঁড়া মুসলমান ছেলে ও মেয়েরাই যে আই এস এ যোগদান করেছে তাও নয়।
আমার এই সব বর্ণনা দেয়ার একটাই কারণ। কোনো অবস্থাতেই এই দেশে আমরা যেন নিজেদের বিভিন্ন অর্জন সত্যেও নিজেদেরকে এই দেশের কালোদের চেয়ে উঁচু ভেবে বসে না থাকি। সাদারা সকল স্তরের উপরে, কালোরা সকল স্তরের নিচে এবং আমরা তার মাঝামাঝি, এই চিন্তাধারা আমাদের অবচেতন মনে গেঁথে গেছে অনেক আগেই। এই মানসিকতা ভাঙ্গতে হবে এবং এই দেশ ও দুনিয়াটাকে দেখতে হবে একটা নতুন আঙ্গিকে। আমরাও যুক্তরাজ্যে আশির দশকে সাদাদের কাছ থেকে প্রচুর বর্ণবাদিতার শিকার হয়েছি। মুখের উপর ভারত উপমহাদেশীয় আমাদের সবাইকে ঘৃণাত্মক “প্যাকি” শব্দটা ব্যবহার করে গালি দেয়া হয়েছে। ইংরেজি বলার সময় আমাদের উপমহাদেশীয় টান ও উচ্চারণকে সবখানে ভ্যাঙ্গানো, ব্যঙ্গ এবং উপহাস করা হয়েছে।
১৯৭৮ সালে আলতাব আলী নামের এক বাংলাদেশি তরুণকে পূর্ব লন্ডনে তিন জন বর্ণবাদী যুবক খুনও করে। শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠতায় বিশ্বাসী “ন্যাশনাল ফ্রন্ট” নামক একটি বিলেতি বর্ণবাদী রাজনৈতিক দলের প্ররোচনায় উদ্ভুদ্ধ হয়ে সাদা যুবকরা তাকে হত্যা করে। এখানে বলতে হবে যে আজ আমি যখন এই লেখাটি লিখছি তখন লন্ডনের ট্র্যাফালগার স্কয়ারে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠতায় বিশ্বাসী কিছু চরমপন্থী দলের মানুষরা চার্চিলের মূর্তি বাঁচাতে বিশাল বিক্ষোভ মিছিল করেছে। বিলেতি সাম্রাজ্যবাদ চলাকালীন সময়ে ভারত উপমহাদেশের প্রতি চরম বর্ণবাদী মনোভাব যেই বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী প্রকাশ করেছিলেন, যিনি আমাদেরকে জন্তু-জানোয়ারের সাথে তুলনা করেছিলেন, যার নীতির কারণে ১৯৪৩ সালে সমগ্র বাংলায় দূর্ভিক্ষের কারণে ২০ থেকে ৩০ লক্ষ মানুষ মারা যায়, তার মূর্তি ভাঙ্গা বা সরিয়ে ফেলাকে আমরা যদি সমর্থন নাও করি, অন্তত এই দেশের কালোদের বর্তমান আর্তনাদের সাথে আমারা একাত্মতা প্রকাশ করতে পারি।
এবং সেটা শুরু করতে হবে আমাদের বাংলাদেশেই। সব চেয়ে আগে বর্তমান সময়কার একটি ব্যাপার নিয়ে বাংলাদেশের সবাইকে অবহিত হতে হবে। ইংরেজি কথ্য ভাষা এবং এখনকার লিখিত ভাষা থেকে “নিগ্রো” শব্দটার ব্যবহার অনেকটা আল্লাহ-রসুলের বদনাম করার মত হয়ে গেছে। আধুনিক সমাজে এই শব্দটার ব্যবহার এখন একেবারেই নিষিদ্ধ। এই ব্যাপারে অধিকাংশ পশ্চিমা সমাজ এক মত হতে পেরেছে। কালোরা অনেক সময়ে নিজেদের মাঝে নিজেদের কথা বলার জন্য অথবা নিজেকে সম্বোধন করার জন্য এই শব্দটা ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু সেটা তাদের ব্যাপার। আমাদের ব্যাপার না। এর কারণ নিগ্রো শব্দটা ছিল আমেরিকায় সেই কৃতদাসদের কপালে কালী মেখে দেয়া একটা জঘন্য গালি, ঠিক যেমনটি “প্যাকি” শব্দটি ছিল বিলেতে আমাদের কপালে মেখে দেয়া একটা গালী। আমাদের বাংলা আলাপচারিতা এবং কোনো কোনো বাংলা লেখায় এখনো নিগ্রো শব্দটা অজ্ঞতার সাথে ব্যবহার করা হয়। এটা বন্ধ করতে হবে। সাথে এটারই ব্যতিক্রমী একটি আরও বাজে শব্দ “নিগার”কেও পরিত্যাগ করতে হবে।
নব্বইয়ের দশক থেকে শুরু করে অনেক দিন পর্যন্ত সম্ভ্রান্ত আলাপে আমেরিকার কালোদেরকে “আফ্রিকান-আমেরিকান” (African-American) বলা হয়েছে তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী। তবে এখন আস্তে আস্তে শুধু “ব্ল্যাক” (Black) বা ব্ল্যাক-আমেরিকান বলার চলও তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য। আর এই কারণেই বর্তমান আন্দোলনের নামঃ “ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার” বা কালোদের জীবন মূল্যবান। আমরা আমাদের মাঝে কালোদের নিয়ে কথা বলার সময়ে “কালো” বা “কৃষ্ণাঙ্গ” বা “কৃষ্ণবর্ণ” বলতে পারি। এতে মুমিনরা অবশ্য চিল্লাতে পারে যে কালোদেরকে হিন্দু বানিয়ে দেয়া হচ্ছে কেন? আমেরিকাতে মুষ্টিযুদ্ধের কালো রাজা “মোহাম্মদ আলী” তো মুসলমান ছিলেন! মুমিনদের সব প্যাঁচালের মতো এতেও কর্ণপাত না করে আমরা ‘ন’ দিয়ে শব্দটা সম্পূর্ণ পরিহার করবো। তবে কালো বলতে গিয়ে কাল্লু বা কালা ভূত বললে আবার চলবে না। সেটা হানিকর।
বাংলাদেশে আফ্রিকা মহাদেশ থেকে মানুষরা আসলে বা যুক্তরাষ্ট্র থেকে কোনো কালো মানুষ আসলে আমাদেরকে অবশ্যই সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। কাল্লু, কালা, ইত্যাদি শব্দের সাথে এরা অনেকেই এখন পরিচিত। আর কালোদেরকে সন্মান করাটা নামের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। তাদেরকে দেখে তাদের প্রতি আমাদের মনে কী অনুভূতি জাগ্রত হয় এবং কোনো কোনো সময়ে সেটার বহিঃপ্রকাশ কী রূপ নেয় তা ভালোভাবে লক্ষ্য করতে হবে। ইউরোপ বা আমেরিকা থেকে সাদারা আমাদের দেশে আসলে আমরা অনেকেই হা করে এবং ফ্যানা তুলে মুখ ছ্যাড়াব্যাড়া করে ফেলি। এটাই হচ্ছে সারা দুনিয়াতে সাদাদের জন্য স্থাপিত “শ্বেতাঙ্গ সহৃদয়তা” (হোয়াইট প্রিভিলেজ, white privilege)। অন্য দিকে আমাদের দেশে কালো কেউ আসলে তাদেরকে কোন ধরণের সহৃদয়তা বা আতিথেয়তার সন্মুখিন হতে হয় তা আমাদেরকে ভালোভাবে বুঝতে হবে। মোদ্দাকথা আমাদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত গাঢ় রঙের চামড়ার মানুষদেরকে আমরা কী চোখে দেখি সেটাকে বিশ্লেষণ করে ভালোভাবে অনুধাবণ করতে হবে। কারণ সেটাই বর্ণবাদিতার উৎস।
দুইশো বছর বিলেতিদের দাসত্ব করার ফলে, না কি ভারত উপমহাদেশে অনেক আগে থেকেই জাত প্রথা থাকার ফলে, না কি পশ্চিম এশিয়া থেকে আগত মানুষের স্থাপন করা মোগল সাম্রাজ্যের আধিপত্যের কারণে আমাদের মাঝে ফরসাকেই শ্রেয় মনে করার প্রবণতা এসেছে, তা গবেষণা করার বিষয়। তার উপর ভারতীয় জন্মপ্রিয় সংষ্কৃতিতে আমরা দেখি বিখ্যাত শিল্পীরা “ফেয়ার এন্ড লাভলি” জাতীয় ক্রিমের বিজ্ঞাপন করে সবাইকে ফরসা হওয়ার আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। সুক্ষভাবে চারিদিক থেকে আমাদের মনে গেঁথে দেয়া হয়েছে এবং হচ্ছে যে ফরসাই সৌন্দর্যের মাপকাঠি। তা না হলে আমাদের পরিবারের লোকজন ফরসা বৌ খুঁজে বেড়ায় কেন? টিভি ও চলচিত্রের পর্দায় তুলনামূলকভাবে ফরসাদেরই দাপট কেন? বাংলাদেশের সমকামীরা অনেকেই ফরসা জীবন সঙ্গী বা যৌন সঙ্গী খুঁজে বেড়ায়। ছেলে বা মেয়ে, বিষমকামী বা সমকামী যেই হোক না কেন, শ্যামলাদেরকে খুব ভালোভাবেই জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে বাংলাদেশের সমাজে তাদের কোনো মূল্য নেই। এই পরিস্থিতিটিকে কি একটি সুস্থ ও মানবিক সমাজ ব্যবস্থা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়?
একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়ে আমি শেষ করছি। কয়েক বছর আগে দেশে বেড়াতে এসে আমি একজন তুরুণ সমকামী ছেলের সাথে দেখা করি যার সাথে অনলাইনে আগে থেকেই পরিচয় ছিল। ছেলেটি প্রথম থেকেই আমাকে বলেছে যে সে শ্যামলা এবং তাকে কেউ পছন্দ করে না। এই নিয়ে তার হীনমন্যতা আর বিষন্নতার সীমা ছিল না। আত্মবিশ্বাসটা কী সেটার সে কিছুই জানতো না। বাংলাদেশের মত দেশে একজন শ্যামলা সমকামী ছেলে হওয়াতে সে মেনে নিয়েছিল যে তার জীবন ছিল একটা অভিশাপ। আমি তার সাথে দেখা করে তার সৌন্দর্য দেখে এতোটাই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম যে আমার কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না তার মনের অবস্থার কথা। শ্যামলা, ধলা, যে যেটাই হোক! সুষ্ঠ জীবন যাপন, যেমন সঠিক খাবারটি খাওয়া (ফলমূল, শাকসবজি ইত্যাদি), কিছু বেয়াম করা (যদি কায়িক পরিশ্রম না করে থাকতে হয়) এবং মাথার উপর একটা নিশ্চিত ছায়া থাকলে (আর সাথে একটু সতেজকারক ক্রিম থাকলে!) যে কারোরই ভেতর থেকে সৌন্দর্যটা ফুঁটে ওঠে বাঁধহীণ নদীর মত। সেই ছেলেটির বেলায় হয়েছিল ঠিক তাই। কিন্তু সেটা সে তার জীবনে বিন্দুমাত্র অনুধাবণ করতে পারেনি।
এর কারণ শ্যামলা যে অসুন্দর এই ধারণা আমরাই তার মস্তিষ্কে অনেক আগে ঢুকিয়ে দিয়েছি। এবং এই কারণে হীণমন্যতা তাকে তীলে তীলে গ্রাস করে খেয়েছে। নিজের আয়নায় সে দেখেছে অবাঞ্ছিত একটি প্রাণি, যেখানে আমি দেখেছি একটা পদ্ম, শাপলা আর রক্তজবার সম্ভার। আদৌ সে নিজের অপরূপকে চিনতে ও বিশ্বাস করতে পেরেছে কি না তা সন্দেহ।