রিয়াজ ওসমানী
১২ জুন ২০২০
এই শিরোনাম দিয়ে লেখার দ্বিতীয় পর্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গ (কালো)দের বিভিন্ন অর্জন এবং উত্তরের অঙ্গরাজ্যগুলোতে বিভিন্ন শহর ও শহরতলিতে ছিটমহল জাতীয় এলাকায় তাদের অনেকের আবাসের ফলে বর্তমানে তাদের বিভিন্ন সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পারিবারিক সমস্যার কথা তুলে ধরেছিলাম। আর এই লেখাগুলোর অনুপ্রেরণা পেয়েছি সম্প্রতি একটা ঘটনা থেকে যেটার সম্বন্ধে আপনারা আশা করি ভালোভাবে অবগত হয়ে গেছেন। মুঠোফোনের পর্দায় জর্জ ফ্লয়েডের “আমি নিশ্বাস নিতে পারছি না” আর্তনাদটি বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে যে যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশ প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থার আমূল সংস্কার প্রয়োজন। আর পুলিশি সহিংসতা এবং বৈষম্যের ভিত্তিতে কালোদের উপর আইনের অপেক্ষাকৃত শক্ত প্রয়োগের মূল কারণ নিয়ম মাফিক এবং প্রতিষ্ঠানিক বর্ণবাদিতা।
প্রথম পর্বে উল্লেখ করেছি যে কৃষ্ণাঙ্গরা উপরে বর্ণিত পরিস্থিতিটি নিয়ে আগে প্রচুর কথা বললেও সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্বেতাঙ্গ (সাদা)রা এই সব কথায় বিন্দু মাত্র কর্ণপাত করেনি এতো দিন। কিন্তু আজকে বিভিন্ন মার্কিন শহর ও উপশহরে মানুষের মিছিলে রয়েছে সাদারা। বিশেষ করে তরুণ সাদারা এই সব মিছিলে এবং সামাজিক মাধ্যমে বড় রকমের ঝড় তুলে ফেলেছে, যা আমেরিকার ইতিহাসে এই প্রথম। মুঠোফোনের পর্দা কোনো সময় মিথ্যা কথা বলে না। তাই এবার মার্কিনি শ্বেতাঙ্গদের টনক নড়েছে। তারা বলছে “যথেষ্ট হয়েছে, আর নয়”। দীর্ঘ দিনের প্রচেষ্টার পর এরা বোধহয় আসলেই এবার কালোদের পরিণতিটা সঠিকভাবে অনুধাবণ করতে পেরেছে। আগের পুলিশি বর্বরতায় কালো মানুষ নিহত হওয়ার পরও অনেকেই আশা রেখেছিল এবার বুঝি পরিবর্তন আসবে। কিন্তু সেই পরিবর্তন আসেনি। কেন যেন এই বার মনে হচ্ছে পরিবর্তন আসার হলে এইবারই আসবে।
ফিরে আসতে হয় ৪০০ বছর আগ থেকে শুরু করে অনেক দিন পর্যন্ত আফ্রিকা মহাদেশ থেকে কৃষ্ণাঙ্গরা আজকের যুক্তরাষ্ট্রে কীভাবে আগত হলো, সেই প্রসঙ্গে। প্রথমে পর্টুগাল, হল্যান্ড ও বেলজিয়াম এবং পরে যুক্তরাজ্য ভিত্তিক কৃতদাস বনিকদের কর্মকান্ডের ফলে আফ্রিকা মহাদেশ থেকে অমানবিক পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে ৩.১ মিলিয়ন আফ্রিকান মানুষদেরকে বিলেতি অধ্যুষিত বিভিন্ন ক্যারিবিয়ান দ্বীপ এবং উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায় পাচার করা হয়। এর মধ্যে ২.৭ মিলিয়ন মানুষ তাদের গন্তব্যস্থলে পৌছতে পারে। বাকিরা পথে জাহাজেই মৃত্যু বরণ করে অমানবিক অত্যাচারের কারণে। বিলেতি বনিকরা আফ্রিকা মহাদেশ থেকে বিলেতি বন্দর দিয়েই জন্তু জানোয়ারের মত করে এই কৃষ্ণাঙ্গদেরকে আটলান্টিক সাগর পার করিয়ে দেয়। এই বন্দরগুলোর নাম আমরা অনেকেই জানি। সেগুলো হচ্ছে ব্রিস্টল (Bristol) আর লিভারপুল (Liverpool). কৃতদাস বানিজ্য থেকে জনৈক বিলেতি বণিকরা এতোটাই লাভবান হয়েছিল, এবং তারা তাদের সেই উপার্জন স্থানীয় এলাকা এবং মানুষদের উন্নয়নের জন্য এমনভাবে নিবেদিত করেছিল যে তাদের স্মরণে ব্রিস্টল সহ অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু মূর্তিও স্থাপন করা হয়।
এমন একজন বনিকের নাম এডওয়ার্ড কলস্টন যার মূর্তি বহু দিন যাবৎ ব্রিস্টল শহরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। যুক্তরাষ্ট্রে জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর প্রতিবাদ যুক্তরাজ্যেও ছড়িয়ে পড়ে। এই দেশের কালো ও কিছু সাদা মানুষদের মিছিলের সময়ে গত ৭ তারিখে (৭ জুন ২০২০) সেই মূর্তিটিকে দড়ি দিয়ে টেনে নামিয়ে পাশের নদীতে ফেলে দেয়া হয়। বিলেতের ইতিহাসে এমন ঘটনা এই প্রথম। বলা বাহুল্য এই ঘটনা নিয়ে এই দেশে পক্ষে আর বিপক্ষে বিতর্কের অবকাশ নেই। পক্ষে আর বিপক্ষে কারা আছে তার একটু ব্যাখ্যার প্রয়োজন।
এই দেশে এক বিশাল জনগোষ্ঠী আছে (অধিকাংশই শ্বেতাঙ্গ) যারা তাদের অতীত ইতিহাস সম্বন্ধে একেবারেই অজ্ঞ। এটা ঢালাওভাবে বলা যায় যে বিলেতি ইতিহাস সম্বন্ধে এই দেশের মানুষদেরকে যা শেখানো হয় তা সাবান দিয়ে ঘষামাজা করা একটা চকচকে সংস্করণ। এখানে ঠাই পায়নি কৃতদাস বানিজ্যে তাদের ভূমিকা, আফ্রিকা মহাদেশে বাস করা মানুষদের উপর তাদের হত্যাকান্ড, অন্যান্য অত্যাচার এবং নির্ভেজাল বর্ণবাদিতা। এখানে ঠাই পায়নি ২০০ বছর ধরে ভারত উপমহাদেশ থেকে সম্পদ আহরণ করে প্রাক্তন একটি সমৃদ্ধশালী অঞ্চলকে তুমুল দারিদ্রে ঠেলে দেয়ার কাহিনী। ঠাই পেয়েছে একটি হাস্যকর আখ্যায়িকা। আর তা হচ্ছে বিলেতিরা সারা দুনিয়াতে ছড়িয়ে পড়ে অন্য বর্ণের মানুষদের সভ্য করার জন্য। আর এই প্রয়াসের পেছনে ছিল নিজেদের নিয়ে “শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠতা” (হোয়াইট সুপ্রেমেসি, white supremacy) নামক একটি বিশ্বাস। লক্ষ্যনীয় বিষয় হচ্ছে যে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলের অঙ্গরাজ্যগুলোতে কালোদেরকে কৃতদাস করে রাখাকে সেখানকার সাদারা এই বিশ্বাসের ভিত্তিতেই মূল্যায়ন করতো। দক্ষিণ আফ্রিকা দেশটিতে হল্যান্ড থেকে আগত শ্বেতাঙ্গ ঔপনিবেশিকরা এই আখ্যায়িকা ও বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করেই বহু বছর সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষ্ণাঙ্গ জনগনের উপর লাঙ্গল চালিয়েছে।
ইতিহাস সম্বন্ধে অজ্ঞ, সংশয়বাদী বা ঘষামাজা করা সংস্করণে বিশ্বাসী বিলেতি নাগরিকরা, যারা অধিকাংশই সাদা ইংরেজ, তারা ঐতিহাসিক মূর্তি ভাঙ্গা বা সরিয়ে ফেলার চরম বিরোধিতা করছে। তাদের তর্ক অনুযায়ী মূর্তি সরিয়ে ফেললে ইতিহাস মুছে যাবে। ইতিহাস কীভাবে মুছে যাবে সেটা এখানে যথেষ্ট তর্কের বিষয়। আর ইতিহাসের কোন সংস্করণটি মুছে যাবে বলে তারা ভয় পাচ্ছে সেটা নিয়ে বিতর্ক এখন বাড়বে। সাথে বাড়তে পারে এই দেশের কালোদের প্রতি এই দেশের কিছু প্রকাশ্যে বর্ণবাদী রাজনৈতিক সদস্যদের বিদ্বেষ।
অপর দিকে মূর্তি সরিয়ে ফেলার পক্ষে আছে এই দেশের অধিকাংশ কালোরা এবং কিছু সাদারা। তো এই দেশে কালোরা এলো কোথা থেকে বলতে পারেন? আফ্রিকা মহাদেশ থেকে কৃতদাস ধরে ধরে যেসকল বিভিন্ন ক্যারিবিয়ান দ্বীপে তাদেরকে স্থাপন করা হয় সেই সব বিলেতি সাম্রাজ্যের অঞ্চল, পরে যেগুলো স্বাধীন দেশে অবতীর্ণ হয়, সেগুলো থেকেই দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর বিলেতে মানুষ আসে বিভিন্ন নিম্ন পেশার কাজ করার জন্য এবং এই দেশটির পুনর্গঠনে অবদান রাখার জন্য। এই দেশগুলোকে একত্রে বাংলাদেশের ক্রিকেট প্রেমিরা ওয়েষ্ট ইন্ডিজ নামে চিনে থাকবে। আরো আসে আফ্রিকা মহাদেশের নাইজেরিয়া এবং অন্যান্য অনেক পার্শ্ববর্তি দেশ থেকে যেগুলো কয়েক দশক আগে বিলেতিদের অধীনে ছিল। বলে রাখা উচিৎ যে বিলেতি সাম্রাজ্যের অধীনে সকল অঞ্চল ও বর্তমানে স্বাধীন দেশ থেকে সকল মানুষদের জন্য যুক্তরাজ্য আশির দশকের প্রায় শেষাংশ পর্যন্ত দরজা উন্মুক্ত রেখেছিল। কোনো প্রকার ভিসা ছাড়াই উল্লেখিত মানুষগুলো এই দেশে এসে বসতি স্থাপন করতে পারতো এবং করেছে।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও আফ্রিকা থেকে আগত এদের ছেলে ও মেয়েরা আজ এই দেশের সমান নাগরিক হওয়ার দাবী রাখে। পপ সঙ্গীত এবং ক্রীড়াঙ্গনে এদের ভূমিকা অতুলনীয়। কেউ কেউ হয়েছেন সাংসদ, টিভি সাংবাদিক এবং কৌতুকাভিনেতা। কিন্তু ঠিক যুক্তরাষ্ট্রের একটা প্রতিচ্ছবি এই দেশেও দেখা যায়। এই দেশের দরিদ্রদের মধ্যে এদের সংখ্যাই বেশি। সাদা পুলিশের হাতে এই দেশেও কালো যুবক নিহত হয়েছে। ঠিক যুক্তরাষ্ট্রের মত এই দেশের কালোরা একটি অবহেলিত এবং দলিত শ্রেণিতে বদ্ধ। অনেক কালো পরিবারে পুরুষদের মাঝে মদ ও মাদক আসক্তি সাদাদের তুলনায় আনুপাতিক হারে একটু বেশি দেখা যায়। এর সাথে রয়েছে ঘরোয়া সহিংসতা যেখানে স্বামীর হাতে স্ত্রীকে প্রহার, বাবা-মার হাতে শিশুদেরকে প্রহার, যার অস্তিত্ব অপেক্ষাকৃত বেশি। এর প্রভাব কালো তরুণ ও তরুনীদের জীবনে চিরকালের জন্য এক অশুভ প্রভাব ফেলে। কিছুটা বিদ্রোহী মনোভাব নিয়েই তাদের মধ্যে অনেকে মাস্তানগিরি, যৌন অপরাধ, মদ ও মাদক পাচার ও আসক্তিতে জড়িয়ে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রেই বিয়ে বহির্ভুত গর্ভাবস্থা চোখে পড়ে এবং অনেক শিশু শুধু মায়ের যত্নেই বড় হয়। এটা হয়ে যায় একটা চক্রাকার পরিণতি যেখান থেকে অনেকেই এখনো বের হয়ে আসতে পারেনি।
যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশ প্রশাসন এবং বিচার বিভাগে কালোদের বিরুদ্ধে যে প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্য ও বর্ণবাদিতা রয়েছে সেটা সেই দেশের শ্বেতাঙ্গরা এতো দিন স্বীকারই করতে চায় নি। কিন্তু যুক্তরাজ্যের চিত্রটা একটু ভিন্ন। এই দেশে ২২ এপ্রিল ১৯৯৩ তারিখে সাধারণ জনগনদের মাঝ থেকে কিছু সাদা বর্ণবাদী যুবকদের হাতে স্টিফেন লওরেন্স নামের এক কৃষ্ণাঙ্গ তরুণ খুন হওয়ার পর এবং এরপর পুলিশ প্রশাসনের সম্পূর্ণ গাফলতি ও উদ্যোগ নেয়ার অনিহা জনগনের সামনে পরিষ্কার হয়ে যাওয়ার পর এই দেশ স্বীকার করে যে এই দেশের পুলিশ প্রশাসন প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই বর্ণবাদী। পুরো অঙ্গনটিকে ঢেলে সাজিয়ে বর্তমান সময়ের জন্য উপযুক্ত করে তোলার প্রয়াস এখনো বিদ্যমান যা প্রশংসনীয়।
তবে এই দেশের শ্বেতাঙ্গ শ্রমিক শ্রেণির মানুষ, যারা তুলনামূলকভাবে অল্প শিক্ষার এবং আয়ের মানুষ, তাদের মাঝে এখনো প্রকাশ্যে কালো এবং বাদামী (ভারত উপমহাদেশীয়) মানুষেদের প্রতি বর্ণবাদী আচরণ লক্ষ্য করা যায়। আশির দশকে এটা ছিল তুঙ্গে, যদিও তখন সেটার লক্ষ্যবস্তু ছিলো এই দেশে আসা ভারত উপমহাদেশীয়রা। নব্বই দশকের পর এই দেশের অধিকাংশ মানুষরাই নানা বিষয়ে উদারপন্থী মনোভাব দেখাতে শুরু করে। কিন্তু আমাদের সামনে ব্রেক্সিটের অভিশাপ আগত হওয়ার পর এই শ্রেণির মানুষদের মনের বিষ আবারো সমাজে ছোবল মারতে শুরু করে। এদের চোখে ব্রেক্সিট ছিল শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠতা মন্ডিত এবং অভিবাসী (ইমিগ্রান্ট) ব্যতীত বিশ্ব সেরা এক কল্পনার ভূবনে ফিরে যাওয়া। তবে করোনা ভাইরাস এসে সেটা কিছুটা নিস্তেজ করে দিয়েছে। আর এর কারণ এই দেশের সরকারি স্বাস্থ্য সেবায় কর্মরতরা অনেকেই কালো আর বাদামী যারা বিলেতে এই ভাইরাসের কাছে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি প্রাণ হারিয়েছে। হয়তো এবার সবাই বুঝেছে যে এদের জীবন মূল্যবান।