রিয়াজ ওসমানী
১ ডিসেম্বর, ২০১৮
বিগত দশ বছরে আমরা আওয়ামী লীগের কাছ থেকে পেলাম আশাতীত অর্থনৈতিক ও জীবনযাত্রার মানের উন্নতি। এগুলোকে সহায়তা করেছে অবকাঠামো ও যাতায়াত ক্ষেত্রে বিপুল বিনিয়োগ। অন্যান্য বিভিন্ন কর্মসূচির কারণে সামাজিক সূচকগুলো সহ চরম দারিদ্রের হারে এসেছে ব্যাপক ইতিবাচক পরিবর্তন। অর্থনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশ এখন সত্যিকার অর্থে সুন্দর একটা ভবিষ্যৎ দেখতে পারছে। তথ্য প্রযুক্তির বিস্তারের কারণে বর্তমান প্রজন্মের চিন্তাভাবনাই বদলে গেছে। আর এই সরকারের সব চেয়ে বড় অবদান ৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে বাংলাদেশকে কলুষমুক্ত করা এবং জামাতের নিবন্ধন বাতিল করতে উদ্যোগ নেয়া।
এতে মনে হতেই পারে যে আগামী নির্বাচনে শেখ হাসিনার জয় নিশ্চিত না হওয়ার কোনো কারণ নেই। বাংলাদেশিরা কি অতই অকৃতজ্ঞ? কিন্তু আওয়ামী লীগের চাটুকাররা উপরের সত্যি কথাগুলো নির্বাচনের আগে বার বার সবাইকে মনে করিয়ে দেয়ার সময়ে নিচের সত্যি কথাগুলো কৌশলে এড়িয়ে যাবে। এবার সেগুলোর দিকে মনোযোগ দেই।
১) ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পরপরই আওয়ামী লীগ অধ্যাপক ইউনুসকে অন্যায়ভাবে অপদস্ত করে সুশীল সমাজের সাথে নিজের সম্পর্কের অবনতি ঘটায়। এতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তির ব্যাপক ক্ষতি সাধন করা হয়। এটার সপক্ষে নানা যুক্তি শুনেছি। এখন আর তা শুনতে চাই না।
২) শাহবাগ আন্দোলনের সমাপ্তির পর হেফাজতকে নিষ্ক্রিয় না করে বরং তাদেরকে ভয় পেয়ে শেখ হাসিনা এদেরকে দুধ আর কলা খাইয়ে পুষতে আরম্ভ করলেন। এর ফলে হেফাজত ঠিকই বসতে দিলে শুতে চাইলো আর শুতে দিলে খেতে চাইলো।
৩) দুই নম্বরের ফলশ্রুতিতে প্রথমে সর্বোচ্চ আদালত প্রাঙ্গন থেকে লেডি জাস্টিসের মূর্তি সরানোর জন্য হেফাজতের দাবীতে প্রধানমন্ত্রী মাথানত করলেন। এর প্রতিবাদ করতে গেলে চাটুকারদের মুখ থেকে শোনা গেলঃ “দেশ-নেত্রীর উপর ভরসা রাখেন”! তারপর পাঠ্যপুস্তকগুলো থেকে ধর্মনিরপেক্ষতার রীতি মুছে দিয়ে ‘অ’তে ‘অজগর’কে বানিয়ে দেয়া হলো ‘অ’তে ‘অজু’ কর। কিছু বিখ্যাত হিন্দু লেখকদের লেখা যা আমরা ছোট বেলায় পড়েছি, তা বইগুলো থেকে সরিয়ে ফেলা হলো।
8) কওমি মাদ্রাসার শিক্ষাকে একটা অন্য আধুনিক শিক্ষার সমান মর্যাদা দেয়া হলো ঠিকই কিন্তু হেফাজতের দাবী মেনে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী সেটাকে সরকারের নিয়ন্ত্রণের আওতায় আনতে পারলেন না আর কওমি শিক্ষাকে ঢেলে সাজিয়ে মানুষ করার ক্ষমতা রাখলেন না।
৫) দুই থেকে চার নম্বর বিষয় থেকে এটা স্পষ্ট যে ধর্মনিরপেক্ষতার বাহক হিসেবে যেই আওয়ামী লীগকে মানুষ চিনতো, তা শেখ হাসিনা বদলে দিয়েছেন। তার মুখ থেকে বিগত আড়াই বছর ধরে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা শোনা যায়নি এবং যেই ধর্মনিরপক্ষতা স্বাধীন বাংলাদেশের একটা মূল স্তম্ভ ছিল, সেটাকে তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে জলাঞ্জলি দিয়েছেন।
৬) পাঁচ নম্বরের পূর্বসুরী হিসেবে ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী পূর্ব জেনারেলদের দ্বারা (জিয়া ও এরশাদ) বাংলাদেশের কলুষিত সংবিধানকে সংশোধন করার সময়ে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঠিকই রেখে দিয়েছেন। ভোটের রাজনীতি করতে গিয়ে তিনি ভুলে গিয়েছেন যে একটা রাষ্ট্রধর্ম থাকা মানেই সেই ধর্মের বাইরে অন্য ধর্মের মানুষ এবং নাস্তিকরা রাষ্ট্রের চোখে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক।
৭) এই মানসিকতার প্রতিফলনস্বরূপ আমরা দেখতে পাই যে উগ্র ইসলামি জঙ্গিরা যখন আওয়ামী লীগের শাসনামলে একটার পর একটা মুক্তমনা ও নাস্তিক ব্লগার, অভিজিৎ রায়ের মত বিখ্যাত লেখক, জুলহাজ ও তনয়ের মত যৌন সংখ্যালঘু অধিকার কর্মী, কিছু সাংষ্কৃতিক মানুষ (লালন ও বাউল) এবং বিভিন্ন হিন্দু, ও খ্রিস্ট ধর্মগুরুদের হত্যা করতে শুরু করলো, তখন সরকারের ভূমিকা ছিল জঘন্য। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখ থেকে বার বার শোনা যেত যে এগুলো ছিল বিচ্ছিন্ন ঘটনা। প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলের উপর দোষ চাপিয়ে খালাস হওয়ার চেষ্টা করেছেন এবং ইসলামের বিরুদ্ধে লেখার জন্য যারা খুন হয়েছে তাদেরকেই দোষারোপ করেছেন। জঙ্গিরা এতে আরও উৎসাহিতই হয়েছিল বৈকি।
৮) ব্যাপার যে দিকে যাচ্ছিল এবং এই নিয়ে সরকারের যেই উদাসীনতা এবং দায়সারা গোছের প্রবণতা দেখা যাচ্ছিল, তাতে ঢাকার গুলশান ক্যাফেতে বর্বর হত্যাকান্ড ছিল মাত্র সময়ের ব্যাপার। তারপর হাজারো বিদেশি চাপে পড়ে সরকারকে বিশেষ কিছু অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোকে (যার অস্তিত্বই শেখ হাসিনা তার আগে অস্বীকার করে এসেছেন), নির্মূল করতে বাধ্য হয়। অথচ সরকারের পূর্বের গতানুগতিক, এবং মুক্তমনা ও নাস্তিকদের নিয়ে রাজনীতি করার মনোভাব না থাকলে গুলশান ক্যাফেতে আক্রমণ হয়তো হতো না। এর সাথে আজ বেঁচে থাকতো জাপানি সেই প্রকৌশলীরা এবং বাংলাদেশের কিছু রত্নরা যারা ধর্মান্ধতা এবং সামাজিক অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন।
৯) মুক্তমনা ও নাস্তিক ব্লগার, অভিজিৎ রায়ের মতো বিখ্যাত লেখক, জুলহাজ ও তনয়ের মতো যৌন সংখ্যালঘু অধিকার কর্মী, কিছু সাংষ্কৃতিক মানুষ (লালন ও বাউল) এবং বিভিন্ন হিন্দু ও খ্রিস্ট ধর্মগুরুদের হত্যার বিচার এই সরকারের কাছ থেকে আমরা আশা করতে পারি না। এই সরকার বিএনপির সব নেতারদের আটক করার ক্ষমতা রাখে কিন্তু অভিজিৎ রায় এবং জুলহাজ-তনয়ের খুনিদের ধরার ইচ্ছা বা ক্ষমতা রাখে না।
১০) এই সরকার প্রমাণ করলো যে বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর আক্রমণ ও জুলুমের দায়ভার খালি প্রাক্তন বিএনপি-জামাত সরকারের উপর চালিয়ে দেয়া আর সম্ভব নয়। বর্তমান সরকারের আমলে লীগের লোকরাই ছিল দেশের আনাচে কানাচে বিভিন্ন হিন্দু পরিবারদের উপর আক্রমণের পেছনে। আওয়ামী লীগ সকল সংখ্যালঘুদের সাথেই করেছে বিশ্বাসঘাতকতা।
১১) ২০১৪ সালের নির্বাচনকে ঘিরে বিএনপি-জামাতের যেই বর্বর উত্তেজনা ও হত্যাকান্ড বাংলাদেশ দেখে, তাতে আওয়ামী লীগ পরে যেভাবে বিএনপি-জামাতকে ঘায়েল করে ফেলার চেষ্টা করে তাতে সাধারণ জনতার সমর্থন থাকাটাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু অনেক বিদেশি সরকার ও মানবাধিকার সংগঠনদের কিছু যুক্তিসঙ্গত প্রশ্নের যথাযথ উত্তর সরকার দিতে পারেনি। সেগুলো ছিল বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার, গুম, ও বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড। এগুলো একটা সভ্য, আইনভিত্তিক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের একেবারেই পরিপন্থি।
১২) সম্প্রতিকালে সরকারি চাকরিতে কোটার সংস্কার ও নিরাপদ সড়ক দাবির আন্দোলন চলার সময়ে আওয়ামী লীগের সত্যিকারের চেহারা ফুটে ওঠে। ছাত্রলীগ ও পুলিশকে ব্যবহার করে সরকার যেভাবে নিরীহ ছাত্র-ছাত্রীদের উপর আক্রমণ চালিয়েছে তা ছিল অভাবনীয়। কোটা আন্দোলন নিয়ে দেয়া সরকারের প্রাথমিক প্রতিশ্রুতিও ছিল মিথ্যা।
১৩) বহু প্রতিবাদ সত্যেও সরকার গায়ের জোরে পাস করে ফেললো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো একটি কালো আইনকে। সরকার বললো যে সাংবাদিকদের ভয়ের কোনো কারণ নেই, বাকস্বাধীনতা খর্ব করা হয়নি ইত্যাদি ইত্যাদি। অথচ যেই ৫৭ ধারাকে বিলুপ্ত করে তার চেয়েও ভয়াবহ এই আইন আসলো, সেই ধারায় অনেক সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে যে বানোয়াট মামলা আনা হয়েছে যেটা সরকার স্বীকারও করেছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস করিয়ে সরকার আবারও প্রমাণ করলো যে তারা দেশ শাসনের নৈতিক অধিকার হারিয়ে ফেলেছে।
১৪) এই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ভুল প্রয়োগ করেই সরকার অধ্যাপক শহিদুল আলমকে গ্রেফতার করলো। যারাই আলজাজিরাতে দেয়া অধ্যাপকের ইংরেজি সাক্ষাৎকারটি দেখেছেন তারা সাথে সাথেই বলতে পারবেন যে শহিদুল আলম সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন ঠিকই কিন্তু কোনো দেশদ্রোহী কথা বলেননি। অধ্যাপকের বিভিন্ন ফেসবুক প্রচারণায় দেশ বিরোধী কথাবার্তা ফুটে উঠেনি। এবং অবশেষে দীর্ঘ বিলম্বের পর তিনি জামিনে ছাড়া পাওয়ার সময়ে আদালতের বিচারক নিজেই বলেছেন যে পুলিশের করা এজাহারের সাথে ভিডিওতে দেখা অধ্যাপকের কথার কোনো সামঞ্জস্য নেই। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে কি এটাই প্রমণিত হলো না, যে সরকারের মাথা মোটা ও ঘাড় ত্যাড়া হওয়ার সাথে সাথে তার চামড়া হয়ে গিয়েছে একেবারেই পাতলা? বড় বড় রাস্তাঘাট আর সেতু দিয়ে আমরা কী করবো যদি তার সাথে মানুষের বাকস্বাধীনতা কেড়ে নেয়া হয়? সারা দুনিয়া থেকে এই গ্রেফতারের নিন্দা এসে বাংলাদেশের ভাবমূর্তির যে ক্ষতিটা হয়েছে তা নিয়ে আর কিছু বললাম না।
১৫) বাংলাদেশের বিচার বিভাগকে এই সরকার রূপান্তরিত করেছে একটা হাস্যকর বস্তু হিসেবে। প্রাক্তন বিচারপতি সিনহার আমলে তখনকার সর্বোচ্চ আদালত বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে একটি রায় দেয়ার পর বিচারপতি সিনহাকে দেশ থেকে নানা কৌশলে বের করে দেয়া হলো। তার বিরুদ্ধে কত দূর্নীতির অভিযোগ শোনা গেল। অথচ বলা বাহুল্য যে আদলত যদি তখন সরকারের পক্ষেই রায় দিত, তখন আর তার বিরুদ্ধে দূর্নীতির কিছু খুঁজে পাওয়া যেত না!
এই হলো বিগত দশ বছরের আওয়ামী লীগ শাসনের একটা চিত্র। বাংলাদেশে আজ ধর্মনিরপেক্ষতা নেই বরং হেফাজত নামক উগ্রদের গলার স্বর দিন দিন বাড়ছে আর বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক চেহারা সাম্প্রদায়িকতার দিকে ঝুঁকে পড়ছে। দেশে নেই সাংবাদিক, মুক্তমনা ও নাস্তিকদের বাকস্বাধীনতা। যত বাকস্বাধীনতা হেফাজতের আর আওয়ামী লীগের চাটুকারদের। একই সাথে নেই ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা – হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্ট, কারোর না। আর যৌন সংখ্যালঘুদের অধিকার আগেও ছিল না, এখন সেই দিন ভবিষ্যতে যেন আর না আসে, হেফাজত পুষে শেখ হাসিনা সেটা সুন্দরভাবে নিশ্চিত করে গেলেন।
আমাদের অপেক্ষাকৃত বিত্তবান কিন্তু অন্ধ দেশকে বাঁচাতে হবে আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে। আওয়ামী লীগের বিকল্প “জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট” মোটেই সহজে হজম করবার মতো কিছু নয়। কিন্তু একটি দল বেশি দিন ক্ষমতায় থাকলে কী হতে পারে তা দেখলাম। যথেষ্ট ঝুঁকি নিয়ে হলেও এই সরকারের বদল কামনা করছি। এবং পরের সরকার পুনরায় ব্যর্থ হলে পরবর্তি নির্বাচনের মাধ্যমে তাদেরও ভরাডুবি কাম্য। এইভাবেই একটা দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বিকাশ ও দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন সম্ভব।
It’s a pity you don’t have a donate button! I’d definitely donate to this brilliant blog!
I suppose for now i’ll settle for bookmarking and adding your
RSS feed to my Google account. I look forward to brand new updates and will share this blog with my Facebook group.
Talk soon!
LikeLike
Donate button is now available. I will be grateful for your kind donation. Thank you.
LikeLike